শহর কলকাতার পুজোর আলোচনায় বনেদি বাড়ির পুজোর উল্লেখ থাকবে না, এটা ভাবাই অসম্ভব। উত্তর কলকাতা মানেই আমাদের কাছে প্রাচীন ইতিহাস এবং বনেদি বাড়ি আর তার ঐতিহ্য। এসব কিছুর মিশেলে তৈরি একটা খাঁটি বাঙালিয়ানা। অনেকেই আছেন যারা পুজোর প্রচন্ড ভিড় এড়িয়ে কলকাতার কাছেই কোনো বনেদি পরিবারের পুজোর স্বাদ নিতে বেশি আগ্রহী। এইসব পুজোর জাঁকজমক অনেকটাই ফিকে হয়েছে, তবে বদলায়নি পুরনো সমস্ত প্রথা। বর্তমান প্রজন্মের হাত ধরে বহাল তবিয়াতে পালিত হচ্ছে সেসব বনেদি বাড়ির রীতি। তেমনই এক ইতিহাসে মোড়া ঐতিহ্যশালী বাড়ির পুজো হল পাথুরিয়াঘাটার রাজবাড়ির ঐতিহাসিক পুজো। পরিচিত খেলাৎচন্দ্র ঘোষের পুজো হিসেবেও।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ৪৬ নং পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটের বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেন ঘোষ বংশের পূর্বপুরুষ রামলোচন ঘোষ। এরপর ১৮৪৬ সাল নাগাদ তার মেজ নাতি খেলাৎচন্দ্র ঘোষ পুরনো বাড়ির পাশেই ৪৭ নং পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটে দুর্গাদালানসহ নতুন বাড়ি তৈরি করেন এবং সেখানে দুর্গাপুজো শুরু করেন। এই বাড়িই পাথুরিয়াঘাটা প্রাসাদোপম রাজবাড়ি নামে পরিচিত। ঠাকুর দালান ঘিরে চারপাশে রাজবাড়ি। প্রত্যেকটি থামের গায়ে বসানো সাদা পাথরের অপূর্ব মূর্তিগুলোই হল এই রাজবাড়ির জ্বলন্ত ইতিহাস। এই বাড়িতে পা পড়েছে বিখ্যাত সব মনীষীর, যেমন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস, গান্ধীজী এবং কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়েরও।
নয় নয় করে প্রায় দেড়শো বছরেরও বেশি বয়স হয়েছে এই পুজোর। এবাড়িতে দেবীর বোধনের আগে পুজো হয় মধুসূদন ও রামকৃষ্ণ দেবের। এরপর সপ্তমীতে কলাবউ স্নান করানো হয় বাড়িতেই। পুজোর প্রতিদিনই সদবা ও কুমারী পুজো হয়ে থাকে। অষ্টমীর দিন হাজার একটা পদ্ম নিবেদন করা হয় প্রতিমাকে। এখানে বলি প্রথাতে রয়েছে অনবদ্য এক চমক। পশু বলি নয়, এখানে বলি দেওয়া হয় চিনির মঠ, যা আনা হয় কাশী থেকে বিশেষভাবে তৈরি করিয়ে। পুজোর ভোগে থাকে লুচি, মিষ্টি, মালপোয়া,নারকেল নাড়ু, নারকেলের চন্দ্রপুলি, চন্দের ক্ষীর, ফলমূল এবং চালের নৈবেদ্য তো রয়েইছে।
এই রাজবাড়ি আজ হেরিটেজ সাইটের তকমাপ্রাপ্ত। এখানে বিসর্জনের সময় সিঁদুর খেলার পর প্রতিমাকে কনকাঞ্জলি দেওয়া হয়। আগে প্রথা ছিল সাতবার বন্দুক দেগে প্রতিমাকে ঘাটের দিকে নিয়ে যাওয়া হত। এখন অবশ্য সেসব অতীত। বর্তমানে গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে দুটি নৌকায় প্রতিমাকে বসিয়ে সাতবার ঘোরানোর পর হয় বিসর্জন। তবে এখানে কখনই প্রতিমাকে শুইয়ে বিসর্জন দেওয়া হয় না। পুজোর কদিন পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরাও সামিল হন মহানন্দে। পুজো দেখার পাশাপাশি এই রাজবাড়ির ইতিহাসকে কাছ থেকে উপলব্ধি করার এ এক মোক্ষম সুযোগও বটে!
চিত্রঋণ – অভিষেক ঘোষাল, গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
Discussion about this post