মৈনাক পর্বতের মতো নাক, ৩৬ ইঞ্চি বুকের ছাতি এবং গড়ের মাঠে গোরা পিটিয়ে চ্যাম্পিয়ন। মানুষটিকে চিনে নিতে সাহিত্যপ্রিয় বাঙালির কাছে এইটুকুই যথেষ্ট! তিনি আট থেকে আশি সকলেরই দাদা, সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি ‘টেনিদা’। নামটি শুনলেই সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়তে বাধ্য প্যালা, হাবুল, ক্যাবলা, চাটুজ্জেদের রোয়াক। সর্বোপরি পটলডাঙা স্ট্রিটের কথা। কিন্তু জানেন কি, বাংলা সাহিত্যের জগতের এই স্থান-কাল-পাত্র সবই বর্তমান বাস্তব জগতেও? আপামর বাঙালির ‘টেনিদা’, এই পটলডাঙার মানুষের কাছে আজও তাদের আদরের ‘টেনি জেঠু’।
উত্তর কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিট ও হ্যারিসন রোডের সংযোগস্থল থেকে একটু এগিয়ে সরু গলিটায় ঢুকে, আবার কয়েক পা এগোলেই ডান হাতে মিলবে সেই পরিচিত গলিটা। সময়ের সঙ্গে অনেকটাই বদলে গেলেও, এই গলিতেই পাবেন টেনিদার বাড়ি এবং চারমূর্তি তথা টেনিদা, প্যালারাম, ক্যাবলা ও হাবুলদের আড্ডার স্মৃতিবিজড়িত সেই চাটুজ্জেদের রোয়াক। এলাকার প্রবীণ বাসিন্দারা আজও ভোলেননি বাস্তবের টেনিদা, অর্থাৎ, এই পটলডাঙা স্ট্রিটের ২০ নম্বর বাড়ির বড় ছেলে প্রভাত মুখোপাধ্যায়কে। তাঁদের থেকেই জানা যায়, প্রভাতবাবুর মৃত্যুর পর মালিকানা বদলেছে মুখোপাধ্যায় (গল্পে নাম বদলে চাটুজ্জে) বাড়ির। লোহার জালে ঘেরা হয়েছে রোয়াক, বাড়ির গায়ে পড়েছে নতুন রঙের প্রলেপ। তাঁদের থেকে জানা যায় প্রভাতবাবুর ‘টেনিদা’ হয়ে ওঠার কাহিনীও। প্রভাতবাবুর বাড়ির বিপরীতে ২২ এ নম্বর বাড়িতেই প্রথমে ভাড়া থাকতেন সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। বাড়িওয়ালা প্রভাতবাবুই পরবর্তীতে লেখকের কল্যাণে হয়ে ওঠেন ‘ভজহরি’, ওরফে ‘টেনি’। বাঙাল-পোলা হাবুল সেন আর পড়াশোনায় ওস্তাদ ক্যাবলার চরিত্রাঙ্কনও করেন লেখক প্রভাতবাবুর দুই ভাইয়ের নামেই। হাবুর সঙ্গে ‘ল’ যোগ করে তিনি বানিয়েছিলেন ‘হাবুল’। আর লেখকের জবানি ফুটে উঠত যার মুখে, সে হল পিলের রোগে ভোগা, পটল আর শিঙি মাছের ঝোল খাওয়া প্যালারাম। বাস্তবের মানুষগুলোর সঙ্গে গল্পের চরিত্রগুলোর ফারাক ছিল যদিও বিস্তর।
পটলডাঙা স্ট্রিটের পুরনো বাসিন্দাদের মধ্যে সকলের লেখককে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তবে সকলের স্মৃতিতেই উজ্জ্বল তাঁদের ‘টেনি জেঠু’। কচি থেকে বুড়ো, আড্ডার ছলে সকলকেই মাতিয়ে রাখতেন তিনি। বিকেল হলেই রোয়াকে বসে ফল খেতে খেতে জু়ড়ে দিতেন আড্ডা। গল্পে ঝন্টি পাহাড় যাওয়ার আগে ক্যাবলার বাড়িতে টেনিদার খাওয়া দেখে প্যালারামের পিলে চমকে গিয়েছিল। বাস্তবের টেনিদাও ছিলেন খুবই খাদ্যরসিক। এক ম্যাচে টেনিদার ৩২টি গোলের সত্যতা নিয়ে ধন্দ থাকলেও, রোয়াকের সামনের খোলা জায়গায় ক্রিকেট খেলার সময় মাঝেমধ্যেই হাফ হাতা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে দেখা দিতেন তিনি। ছোটদের দিতেন কাল্পনিক সব নাম, শোনাতেন মজাদার গল্পও। সেই সব গল্প থেকেই নারায়ণবাবু সৃষ্টি করেন ‘টেনিদা’কে। লেখককে মজার ছলে নিজের ছেলেবেলার টিংটিঙে চেহারা নিয়ে বিরাট বড় চ্যাং ঘুড়ি ওড়ানোর গল্প শুনিয়েছিলেন প্রভাতবাবু। লেখকও ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘‘তারপর ওই রোগা চেহারায় ঘুড়ির সঙ্গে নিজেও উড়ে গেলেন তো!’’ সেই গল্প থেকেই পরবর্তীতে জন্ম নেয় ‘ঢাউস’! গল্পের টেনিদা ভূতের নামে মূর্চ্ছা গেলেও, আসল টেনিদার মুখে দারুণ জমত ভূতের গল্পের আসর।
‘ক্যাবলা’ তথা সুভাষচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ছেলে তপন মুখোপাধ্যায়ের কথায়, অদ্ভুত ছিল তাঁর বড় জেঠুর ব্যক্তিত্ব। অসামান্য রসবোধের অধিকারী হলেও ভাঁড়ামো করতেন না তিনি কখনও। এক সাক্ষাৎকারে প্রভাতবাবু নিজেই জানিয়েছিলেন, টেনিদার খ্যাতি তাঁকে বয়ে বেড়াতে হয়েছে বিস্তর। এমনকি নিজের শ্বশুরবাড়িতেও চলত হাসি ঠাট্টা। কিন্তু তার জন্য কোনওদিন বিব্রত বোধ করেননি তিনি। নায়ারণবাবুর ‘চার মূর্তি’ গল্প নিয়ে ১৯৭৮ সালে পরিচালক উমানাথ ভট্টাচার্য তৈরী করেন এক সিনেমা, যেখানে টেনিদার চরিত্রে অভিনয় করেন রোগা পাতলা চেহারার চিন্ময় রায়। কথায় কথায় ভয় পেয়ে ‘টেনিদা’রূপী চিন্ময়বাবুর সেই ভিরমি খাওয়ার দৃশ্য আপামর বাঙালির মনে গেঁথে গিয়েছে। যদিও পর্দা ও বাস্তবের টেনিদাকে মেলাতে চান না পটলডাঙার মানুষজন।
গল্প-বাস্তবের এই অসামান্য মেলবন্ধনেই পটলডাঙা স্ট্রিট হয়ে উঠেছে ‘চারমূর্তি’র স্মৃতির সরণি। ব্যস্ত শহরের এই গলিতে কান পাতলে আজও যেন শোনা যায়, “ডি-লা-গ্রান্ডি-মেফিস্টোফিলিস/ ইয়াক ইয়াক!”
চিত্র ঋণ – ভবঘুরের খেরোর খাতা
Discussion about this post