কথাতেই আছে ‘খাদ্য রসিক বাঙালি’। আর সেই খাবারের তালিকায় মিষ্টি বোধহয় সবার ওপরে। মিষ্টিতে রসগোল্লার পরেই নাম আসে পান্তুয়ার। আর তা যদি হয় রাণাঘাটের তাহলে তো কোনো কথাই নেই। পান্তুয়া তো সাধারণ মিষ্টিই, তার আবার আলাদা কি! রানাঘাটের পান্তুয়ার বিশেষত্বটাই প্রাচীনতার সাথে জড়িয়ে। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমল থেকেই রাণাঘাটের পান্তুয়ার সৃষ্টি। শোনা যায়, জমিদার বাড়ির ময়রা ছানা ভেজে রসে চুবিয়ে জমিদারবাড়ির বাচ্চাদের প্রথম স্বাদ দিয়েছিলেন। সেখান থেকেই নাকি পান্তুয়ার সৃষ্টি। পান্তুয়া শব্দের উৎস স্পষ্ট করে জানা যায় না। তবে কেউ কেউ বলেন, এর উৎপত্তি ‘পানিতুয়া’ শব্দ থেকে। আবার কেউ বলেন, ‘পানিতবা’ শব্দ থেকেই এসেছে পান্তুয়া কথাটি। ‘তবা’ কথার অর্থ ‘নিচে’। যেহেতু এই মিষ্টি চিনির রসে ডুবে থাকে তাই এরূপ নামকরণ। পান্তুয়া কথার উল্লেখ ‘শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত’তে পাওয়া গেছে।
সাধারণত পান্তুয়ার কথা বললে আমাদের চোখে ভাসে গাঢ় বাদামি মিষ্টি। ওপরটা নরম তুলতুলে। তবে এক্ষেত্রে এই পান্তুয়া ব্যতিক্রমী। কালো রঙের মোটা, শক্ত স্তর নিয়েই স্বাদের দেশে জনপ্রিয় রাণাঘাটের পান্তুয়া। আকারে না ঠিক গোল না লম্বা। সে যাই হোক মুখে দিলে ওসব আর মাথায় থাকার নয়। যোগেশ্বর প্রামাণিক ওরফে জগু ময়রার হাত ধরেই এর উৎপত্তি। দেশের বাইরেও এর দারুণ কদর। জগু ময়রার পান্তুয়া যায় সুদূর আমেরিকাতেও। এর পর ১৯২০ সালে প্রভাত প্রামাণিকের হাতে পান্তুয়ার স্বর্ণ যুগ আসে। কলকাতার রসগোল্লা, নবদ্বীপের দই, কৃষ্ণনগরের সরপুরিয়ার সাথে আরামসে পাল্লা দিতে পারে এই পান্তুয়া।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, এখনো যে কোনো অনুষ্ঠানে পান্তুয়ার একচেটিয়া চল আছে। কড়াইতে বেশি ভেজে লালচে আবরণের পুরনো ঐতিহ্য মেনেই পান্তুয়া তৈরি হয়ে আসছে এখনো। দাম বাড়লেও বাঙালির যে কোনো অনুষ্ঠান মিষ্টি ছাড়া অসম্পূর্ণ। এক কালে পুরো ঘি দিয়ে ভাজা হতো পান্তুয়া। এখন ঘি ব্যবহার করা হয় না। আর ছানার গুণমানও আগের মতো নেই। তাতেই প্রতি পিস ৫ টাকা এবং ১০ টাকাও আছে। পাল চৌধুরীদের আমল থেকে চলে আসা পান্তুয়া এখনও বড়দা, মেজদা, সেজদার দোকানে। আর এই বড়দা, মেজদা, সেজদারা জগু ময়রার বংশধরেরা। একসাথে না হলেও স্টেশনের কাছেই তাদের পুরনো দোকানগুলো আজও রমরমিয়ে চলছে।
অন্যদিকে, রাণাঘাটের পান্তুয়ার সাথে জড়িয়ে হরিদাস পাল। কে তিনি? যার হাতের পান্তুয়ার স্বাদ নিতে আসতেন স্বয়ং ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সন্ধ্যা রায়। রাণাঘাট এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে দোকান ছিলো তাঁর। যদিও বর্তমানে তা বন্ধ। তবে পান্তুয়ার দুনিয়ায় দ্বিতীয় হরিদাস পাল পাওয়া দুষ্কর। এতো দোকানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটা নামই বলে দেয় তিনি কতটা কালজয়ী। রাণাঘাটে এসে পান্তুয়ার স্বাদ না নিলে সে যে ষোলো আনাই বৃথা, সে কথা বলাই বাহুল্য।
Discussion about this post