“সাপ লুডো, চিত্রহার, লোডশেডিং, শুকতারা পাঁচসিকে, দুঃখদের গল্প বল, বন্ধু চল”। যাদের ছোটবেলাটা শুকতারা পড়ে কেটেছে তাদের কাছে লোডশেডিং শৈশবের একটা মস্ত বড়ো স্মৃতি। আবার এই লোডশেডিংয়ের সাথে জড়িয়ে রয়েছে এক একটা নষ্টালজিয়া। বাতিটি নেভার সঙ্গে সঙ্গেই পুরো পরিবার জুড়ে ছাদে উঠে ভিড়। শুরু হলো ভূতের গল্পের আড্ডা সঙ্গে রইলো একটি হ্যারিকেন আর একটি তালপাতার হাত পাখা।
সেই গ্রিক রোমান সভ্যতার যুগ থেকে চলে আসছে এই হাত পাখার ব্যবহার। একটু পুরনো দিনে বেড়ে ওঠা প্রায় সকলেই ঠাকুমার পাখার বাতাস খেতে খেতে তার ঝুলি ভরা গল্পের আনন্দ নিয়েছে। তবে সময়ের সাথে হাত পাখার বিবর্তনও হয়েছে অনেকখানি। একেবারে প্রথম দিকে পাখা গুলিতে কোনো প্রকার ভাঁজ ছিল। পরের দিকে কিছু ইউরোপীয় বণিক চিন, জাপান থেকে ফোল্ডিং বা ভাঁজওয়ালা পাখার ব্যবহার শেখেন এবং সেখান থেকে তা আমাদানি করেন। পরের দিকে ওই আঠেরো শতকের প্রথম দিকে ইউরোপে পাখা তৈরি শুরু হয়৷ তখন এই পাখার চাহিদা দুস্প্রাপ্যই ছিলনা, ছিল দূরমুল্যও। পাখার ওপর তখন নানা রকম নকশার সাথে মণি মানিক্য অবধি বসানো হত। পাখায় নকশার মাধ্যমে তুলে ধরা হত তখনকার রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবনকে। তাছাড়া চিন দেশ থেকেও ব্যাপকহারে সুন্দর কারুকার্য করা পাখার আমদানি তো আগে থেকে ছিল প্রচুর। লন্ডনের গ্রিনিচের বিখ্যাত মিউজিয়ামে রয়েছে এই হাত পাখার প্রচুর নিদর্শন। এখানে রয়েছে বিখ্যাত মানুষদের ব্যবহার করা দামী হাতপাখাও, যার সংখ্যা প্রায় ৩০০০ এর ওপরেও।
তবে দুঃখের বিষয় হাতপাখার বিবর্তনের সঙ্গে এটি প্রায় বিলুপ্তির দিকেও ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে বাড়িতে বিদ্যুৎ আসার সঙ্গে সঙ্গে হাতপাখার ব্যবহার কিছুটা কমেছিল। কিন্তু এখন লোডশেডিং হলে কৃত্রিম পদ্ধতিতে বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছে বিদ্যুৎ। ফলতঃ শহরের দিকে তালপাতার সেপাইয়ের সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। তালপাতার হাতপাখার ব্যবহার যদিও গ্রামেগঞ্জে এখনও লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু বিগত বছরের করোনার দাপটে হওয়া দেশজুড়ে লকডাউনের প্রভাব পড়েছে পাখা ব্যবসায়ীদের ওপরেও। আগে রাজা মহারাজের পাখার বাতাস করার জন্য রীতিমতো দু’জন করে লোক নিযুক্ত থাকতো। রাজকীয় ব্যাপার ছিল নকশা করা হাতপাখা ব্যবহারের মধ্যে।
বাড়ির পুরুষেরা খেতে বসলে বধূরা বসে হাত পাখায় বাতাস করতো তাদের। সেই দিন পেরিয়ে আজ আমরা অনেক দূর এগিয়ে এসেছি। এখন বাড়িতে বৈদ্যুতিক পাখার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটছে ঘর ঠান্ডা রাখার যন্ত্ররা। ফলত হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ছোটবেলার একটি অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু। কিন্তু গ্রামেগঞ্জে গেলে আজও দেখা যায় হয় তো কোনো চণ্ডীতলায় বসে কিছু বুড়ো মানুষেরা আড্ডা দিচ্ছে সঙ্গে কারুর হাতে রয়েছে একটি হাতপাখা। অনবরত কথার মাঝেই পাখা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাতাস করে চলেছে গায়ে। হয়তো এভাবেই এখনো বেঁচে আছে আমাদের ছোটবেলার হাতপাখার স্মৃতিরা
চিত্র এবং তথ্য ঋণ – আড্ডা জোন, নবনীতা ব্যানার্জী
Discussion about this post