বাঙালি জাতিকে অনেকেই ‘মিষ্টি জাতি’ বলে থাকে। আর মিষ্টি প্রেমী বাঙালির সংখ্যা তো অগুনতি। আর মিষ্টির কথা এলে গুড়ের কথা আসবে না, তাও আবার হয় নাকি? বাদামি রঙের ওই অর্ধতরল পদার্থটি দেখলেই তিক্ত মনও যেন সুমিষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি ঘরে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ আখের গুড় আর খেজুর গুড়। গুড়ের পায়েস, রসোগোল্লা, সন্দেশের নামেই জিভে জল আসার জোগাড়। আর শীতকালীন গুড় মানেই খেজুর গুড়। খেজুরের রসকে আগুনে জ্বাল দিয়ে ঘন করা হয়। সেই ঘনত্বের ওপর নির্ভর করেই তৈরী হয় ঝোলা গুড়, নলেন গুড়, পাটালি।
খেজুর রসের ভালো-খারাপ হয় মূলতঃ আবহাওয়ার জন্য। কনকনে শীত ও পরিষ্কার আকাশ হলে তবেই রস মিষ্টি হয়। নভেম্বরের শুরু থেকে রস আহরণ হলেও, ডিসেম্বর জানুয়ারিতেই সবচেয়ে বেশি খেজুর রস পাওয়া যায়। দক্ষিণ দিনাজপুরের বাউল এলাকার এক গাছি জানান, গাছের ডগা চেঁছে বাঁশের খিল লাগানোর কাজ বহু আগেই শেষ হয়েছিল। অপেক্ষা চলছিল কনকনে ঠাণ্ডার, এখন রস পাওয়ার শুধু সময়ের অপেক্ষা। তিনি দুঃখ প্রকাশও করেন। যেভাবে নির্বিচারে খেজুর গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে, তাতে গ্রামবাংলার কিছু মানুষের জীবিকায় টান পড়ছে।
শীতের শুরুতেই গাছিরা প্রস্তুত হয় গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য। প্রথমেই খেজুর গাছের মাথাটিকে পরিস্কার করা হয়। এরপর পরিস্কার সাদা অংশটি বিশেষ কায়দায় কেটে ছোট বড় কলসি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। রাতভর কলসি ঝোলানো থাকে এবং কলসিতেই রস সংগ্রহ হয়। গাছিরা ঝুঁকি নিয়ে গাছে কোমরে দড়ি বেঁধে গাছে ঝুলে রস সংগ্রহের কাজ করে। প্রতিদিন বিকেলে ছোট-বড় কলসি (মাটির পাত্র) গাছে বাঁধে তারা। কেউ কেউ কাঁচা রস এলাকার বিভিন্ন স্থানে ও হাটে-বাজারে খাওয়ার জন্য বিক্রি করেন। আবার কেউ কেউ সকালেই এই রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করেন।
পুরুলিয়ার পাড়া, সাঁতুড়ি, কাশীপুর, রঘুনাথপুর, হুড়া, ও অযোধ্যা পাহাড়তলির বাঘমুন্ডি এলাকার খেজুর গাছের গুড়ের স্বাদ অতুলনীয়। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার প্রত্যন্ত দিনহাটা মহকুমায় গুড়ের সন্দেশ, মিষ্টি সহ বিভিন্ন সুস্বাদু খাবারের প্রসার খুব। আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহারের সীমানায় কাশিয়া বাড়ি গ্রামের চারিদিকে খেজুরের গাছের সম্ভার। কার্তিক মাস থেকে এলাকায় শুরু হয়ে যায় খেজুর গুড় তৈরির ব্যস্ততা। মহামারির কবলে জনজীবন ব্যহত হলেও খাদ্যরসিক বাঙালির হেঁশেলে পিঠে পুলি হবে না, তা আবার হয়? আর তার জোগান দিতে বাজারে খেজুর গুড়ের পসরা সাজিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
Discussion about this post