মা থাকবেন আর একটা দিন।পুজোর প্রায় শেষ লগ্ন। শেষবেলায় উমার খাতির যত্নে ফাঁক রাখলে চলবে না। আবার তো সেই এক বছর পর! পাঁজি বলছে আজ মহানবমী। বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধটাও কেমন মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মার সামনে নিবেদন করা হল অন্নভোগ,সাথে রাইখর আর বোয়াল মাছ। কথা হচ্ছে বালুরঘাটের ঐতিহ্যবাহী পাল বাড়ির পুজোর।এই পুজোর সঠিক বয়স স্মৃতিতে নেই কারোর। তবুও আনুমানিক ৩৫০ বছর তো হবেই। এই ৩৫০ বছরে আত্রেয়ী তার পথ বদলেছে কতবার! শহরে পরিণত হয়েছে বালুরঘাট। কিন্তু আত্রেয়ীকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই শহরে বদলায়নি পাল বাড়ির ঐতিহ্য। বদলায়নি এই বাড়ির পুজোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শহরবাসীদের উত্তেজনা।
পুজোর সূচনা এক তান্ত্রিকের হাত ধরে। তিনিই আত্রেয়ীর ধারে স্থাপন করেছিলেন পঞ্চমুন্ডির আসন। সেখানে শুরু হয় শক্তির আরাধনা। এলাকায় সেই সময় খুব একটা জনপ্রিয় ছিলনা দুর্গাপুজো। সেইসময় গৌরী পাল ছিলেন বালুরঘাটের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনিই এখানে শুরু করেন দুর্গাপুজো। সেই সময় আটচালা টিনের ছাউনি, আর মাটির বেদীতেই সম্পন্ন হতো পুজো।
তবে সময়ও এগিয়েছে নিজের মতো। একসময় মহাধুমধামভাবে হওয়া পুজোয় আজও আড়ম্বরে কোনোরকম ভাঁটা পড়েনি। প্রায় ৮০ বছর আগে পাল বাড়ির পুজোর দায়িত্বে এগিয়ে আসেন প্রতিবেশীরাও। তাঁরা চাননি,এই ঐতিহ্যবাহী পুজো বন্ধ হোক কোনোভাবেই। সেই থেকেই পুজোর সব দায়িত্ব সামলে আসছেন তাঁরা। প্রায় ৪০ বছর হল তৈরী হয়েছে পাকা পুজো মন্ডপ। গঠন হয়েছে পুজো কমিটিও। পাড়ার সবাই মিলে পুজোর আয়োজন করলেও আজও এই পুজো পালবাড়ির পুজো নামেই বিদ্যমান। থিম পুজোর ছোঁয়াও লেগেছে খানিক, তবে সাবেকিয়ানা এখনো অটুট। শুধু শহরবাসীই নন, পুজোয় হাজির থাকেন দক্ষিণ দিনাজপুরের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজন। একটি বছর ঘুরে উমা সপরিবারে এল, তাঁকে না দেখলে হয়!
ভক্তদের মনে মায়ের জন্য আলাদা স্থান সবসময়। তাঁদের বিশ্বাস মায়ের কাছে ভক্তি ভরে কিছু চাইলেই মা তার পূর্ণ করেন। এমন কত শত অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী থেকেছে এলাকাবাসী! তবে নবমীর ভোগে থাকে বিশেষত্ব। নয় রকমের ভোগের মধ্যে থাকে রাইখর ও বোয়াল মাছ। তাও পুকুরের রাইখোর নয়,ভোগে প্রয়োজন আত্রেয়ীর রাইখোর মাছই। এটিই পালবাড়ির দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নিয়ম। দশমীতে এখানে করা হয় না অপরাজিতা পুজো। শুরু থেকেই এই নিয়ম। দশমীতে পান্তাভাতের সাথে পুঁটি মাছ নয়, থাকে রাইখোর মাছ ভাজা। যেখানে যেমন নিয়ম! ইন্টারনেট মাধ্যমেই পুজো দর্শনের ব্যবস্থা ছিল গত বছর। এবারও অন্যথা হয়নি। মাকে ঘরে বসেই প্রণাম সেরেছিলেন ভক্তগণ।
প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় এখনো অক্ষুণ্ণ পালবাড়ির পুজোর ঐতিহ্য। যতই মহামারী হোক শহরবাসী মন থেকে এই পুজোর প্রতি ভালোবাসা কমেনি একফোঁটাও। এভাবেই পুরোনো-নতুন মিলেমিশে একসাথে এগিয়ে চলুক পাল বাড়ির বর্ষ প্রাচীন পুজো।
Discussion about this post