বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত, বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির অন্যতম সুন্দরবন। এই বনভূমি বাংলাদেশের এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অনেকটা জুড়ে বিস্তৃত। অনিশ্চিত জনজীবনে আজও সুন্দরবন বঙ্গের অন্যান্য জায়গাগুলি থেকে অনেকটাই পিছিয়ে। আর সুন্দরবনের এই পরিস্থিতি বদলের লড়াইয়ের সাথে মিশে আছে এক অনন্য যোদ্ধার কাহিনী। রাজা, ডাকনামে গোটা সুন্দরবন যাকে চেনে। রাজার পুরো নাম, সৌমিত্র মণ্ডল। সুন্দরবনের গোসাবায় এক অত্যন্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম তার। একটু বড় হলেই পড়াশোনার জন্য নিজের গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় আত্মীয়দের বাড়িতে এসে থাকতে শুরু করে সে। কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ভূগোল অনার্স এবং পরে বি.এড ডিগ্রি পাশ করে রাজা। ছোট থেকেই তার লক্ষ্য ছিল নিজের অঞ্চলের জন্য কাজ করা। শিক্ষা শেষ করে নিজের গ্রামে ফিরে এলে, স্থানীয় একটি সরকারি স্কুলে ভূগোলের পার্ট টাইম টিচারের কাজ পান তিনি।
সামান্য মাইনের চাকরি সত্ত্বেও রাজার স্বপ্ন ছিল পাহাড় সমান। এলাকার গরিব পরিবারের বাচ্চাদের ফ্রি কোচিং করাতে শুরু করে সে। ছাত্র ছাত্রীদের জন্য সরকারি সংস্থার থেকে স্কলারশিপ জোগানের ব্যাবস্থাও শুরু করেন সে। তার এই লড়াইয়ে সাফল্য এল, মাধ্যমিকের ফলের মাধ্যমে। তার ২০ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ১৮ জন ভূগোলে শতকরা আশি পেল। এই ফল স্বপ্নের পথে একধাপ এগিয়ে দিল রাজাকে। সময়টা ২০১৯, পার্ট টাইম টিচার পোস্টটিকে পার্মানেন্ট পোস্ট দিয়ে ভরাট করে দেওয়া হল। চাকরি হারালেন সৌমিত্র। তবে এই চরম আর্থিক অনটনের মাঝেও সে বন্ধ হতে দেয়নি তার বিনামূল্যের কোচিং।
সময়টা করোনা অতিমারির মাঝামাঝি। করোনার সাথে এত নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত হতে চলেছিল তার জীবনে। করোনার প্রকোপে সারা সুন্দরবন যখন ওষুধ, অক্সিজেনের সমস্যায় ভুগছে, তখন নিজের চিন্তা না করেই মানবসেবায় এগিয়ে এল রাজা। অতিমারি আক্রান্ত সুন্দরবনের গ্রামে গ্রামে একটি পুরোনো সাইকেলে চেপে ওষুধ, অক্সিজেন সিলিন্ডার, কনসেন্ট্রেটর পৌঁছে দিতে থাকে সে। ধীরে ধীরে সে পরিচিত হয়ে ওঠে ‘অক্সিজেন ম্যান’ নামে। দ্বীপের বিভিন্ন জায়গায় তাঁর যাতায়াতের সমস্তরকম আর্থিক খরচ জোগান দিতে এগিয়ে আসেন স্থানীয় প্রশাসন।
সৌমিত্র নিজে সিভিয়ার ডায়াবেটিক। ফলে তার সংক্রমণের ঝুঁকিও ছিল বেশ। লড়াই করতে করতে ২০২১-এ জুনে সৌমিত্র নিজেই করোনা পজিটিভ হল। একটু বিরতি, তারপর সেরে ওঠেন। আবার সৌমিত্র কাজে ফিরল, নিজের স্বপ্নে ফিরল। নিজের ফ্রি কোচিংয়ের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, স্কলারশিপের পাশাপাশি তাদের বাল্য বিবাহের কড়া নিষেধাজ্ঞার দিকেও নজর রাখেন। তবে, সকল কাজের মধ্যেও মাঝে মাঝেই চিন্তায় পড়ে যান ৩০ বছরের অক্সিজেন ম্যান। তার কথায়, একটি আর্থিক সংস্থানের অপেক্ষায় আজও তিনি অপেক্ষা করে থাকেন, যাতে আরও ভালোভাবে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে পারেন।
Discussion about this post