এমন একটি সম্প্রদায়, যাঁদের একমাত্র পেশা হল বাঁশের সামগ্রী তৈরি করা। অবাক লাগছে তো? কিন্তু বহুযুগ ধরে এমনটাই হয়ে আসছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি প্রান্তিক অঞ্চলেই পাওয়া যায় কুটির শিল্প, হস্তশিল্পের নমুনা। সারা বাংলা জুড়ে এমন অসংখ্য শিল্পীরা যুগের পর যুগ ধরে বংশপরম্পরায় শিল্প সৃষ্টি করেন, মারা যান। আবার তাঁদের সেই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখেন তাঁরই বংশধর। এই ব্যবস্থা বেশি ঘটে চলে আদিবাসী সম্প্রদায়গুলির মধ্যে। তাঁদের ঐতিহ্যগত এবং জাতিগত পেশাগুলিই তাঁদের অন্যান্য সম্প্রদায়গুলি থেকে আলাদা করে রাখে। ওই শিল্পই তাঁদের পরিচয়, অস্তিত্বের প্রমাণ।
বাংলার আদিবাসী সম্প্রদায়গুলির মধ্যে একটু ঢুঁ মারলেই দেখা যাবে, তাঁদের জীবনযাপন পদ্ধতি, আচার, অনুষ্ঠান এমনকি পেশাও সমাজের বহমান ধারার থেকে অনেকখানি আলাদা। ঐতিহাসিকভাবে এবং জলবায়ুগতভাবে তাঁরা তাঁদের বসবাসের অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। এমনই একটি সম্প্রদায় হল মাহালী। মাহালীদের মতে তাঁদের আদি বাসস্থান ঝাড়খন্ডের দুমকা জেলা। দুমকাকে তাই তাঁরা ‘মারে দিশম’ বলে ডাকেন, যার অর্থ ‘পুরনো ভূমি’। নৃ-তাত্ত্বিক দিক থেকে সাঁওতালদের কাছাকাছি হলেও এঁদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি, সামাজিক আচার। মনে করা হয় ‘মাহালী’ শব্দটি এসেছে আদিবাসী ‘মান্ড’ অথবা ‘মহাল’ শব্দ থেকে। তাঁরা পূর্বে বেশিরভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন, তবে বর্তমানে এই উপজাতির বেশিরভাগ মানুষ খ্রিস্টান।
মাহালীরা সুপ্রাচীন কাল থেকেই বাঁশ ও বেতের সামগ্রী তৈরির মত শিল্প কর্মের সঙ্গে যুক্ত। শারীরিক গঠনের দিক থেকে তাঁরা অস্ট্রিক শ্রেণীভুক্ত। গায়ের রং তামাটে, কম উচ্চতা, কালো চুল, নাক ছোট ও সুঠাম দেহ। এঁরা প্রধান পেশা হিসাবে বাঁশের টুপি, ডালা, ঝুড়ি ইত্যাদি তৈরি করে থাকেন। কিন্তু বর্তমানে অনেকে কৃষিকাজে মন দিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ আধুনিক দুনিয়ায় হাতে তৈরি শিল্পের চাহিদা নেই বললেই চলে। ঝাঁ চকচকে, সহজলভ্য পুঁজির বাজারে প্রত্যন্ত গ্রামের উপজাতিদের বানানো পলকা শিল্পের প্রয়োজনীয়তা কোথায়! এমনটা ভেবেই হয়ত শিল্পকর্মকে দূরে রেখে অন্যান্য কাজে মন দিচ্ছেন মাহালী মানুষেরা।
পুরুলিয়ার বোঙাবাড়ি মাহালীপাড়া, দিনাজপুরের জয়নগরের মাহালীপাড়া, বীরভূমের আহমেদপুরের কচুইঘাটা গ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলের মাহালী পরিবারগুলি চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের শিল্পকর্ম। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁদের সংসার চলছে এই বাঁশের তৈরি হাতের কাজের মধ্যে দিয়ে। মাহালীরা জাতিগতভাবে সাঁওতাল বা মুন্ডাদের মতই সিং বোঙ্গা বা সূর্যদেবতার উপাসক। অন্ধকার অসহায়তার সময় তাঁরা সূর্যের কাছের আলোর প্রার্থনা করেন। তাঁদের জীবনে, তাঁদের শিল্পে, তাঁদের অস্তিত্বে কতখানি পৌঁছয় সেই আলো? প্রশ্ন থেকেই যায়।
Discussion about this post