তখন বাংলার স্বাধীনতা ব্রিটিশদের কারাগারে বন্দী। সালটা ১৯৩৪। মাস্টারদা সূর্য সেনকে অত্যাচারের পর সদ্য ঝোলান হয়েছে ফাঁসিতে। বাংলায় জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন, যার উত্তাপ এসে পড়ে মেদিনীপুরেও। মেদিনীপুরের জেলা শাসক হিসেবে একে একে প্রাণ হারান জেমস পেডি, বার্নাড বার্জ। এরপর পি.জি. গ্রিফিথ মেদিনীপুরের দায়িত্ব নিয়ে কার্যত বোতলবন্দী করে রাখেন গোটা জেলার মানুষকে। অর্থনৈতিক পুঁজি থেকে শুরু করে দুর্গাপুজো আয়োজনের সমস্ত ক্ষমতাই জমিদার গোছের লোকেদের দেওয়া হয়। তথাকথিত নিম্নজাতের মানুষেরা মায়ের চরণ স্পর্শ তো দূরের কথা, দর্শনটুকুও পেত না। মাকে কাছে পাওয়ার প্রবল ইচ্ছার পাশাপাশি এত অত্যাচার, মৃত্যু সমস্তকিছু ওই জেলার মানুষের মনে গড়ে তুলছিল বিশালাকার ঝড়ের তান্ডব।
দুর্গাপুজোকে ধনী-দরিদ্র, জাতপাত নির্বিশেষে সার্বজনীন করে তোলার উদ্দেশ্যে মেদিনীপুরের কর্নেলগোলার কালী মন্দিরে বসল গোপন সভা। সভায় ছিলেন বিপ্লবী অক্ষয়কুমার দাশগুপ্ত, সতীশচন্দ্র আঢ্য, যতীন্দ্রনাথ আঢ্য, অতুলচন্দ্র বসু সহ আরও অনেকে। সমস্ত বাধা পেরিয়ে ঠিক করা হল কর্নেলগোলার দেবনারায়ণ ভকতের খোলা জমিতে আটচালা বানিয়ে হবে পুজো। প্রকট হল আর্থিক সমস্যা। অর্থ সংগ্রহের কাজে এগিয়ে এল বাড়ির মহিলারা। ঠিক করা হল সকলের বাড়িতে হাঁড়ি রেখে তাতে রোজ রান্নার সময় একমুঠো করে চাল ফেলে সেটা সপ্তাহান্তে সংগ্রহ করবে অঞ্চলের ছেলেরা। তা বিক্রি করে জোগাড় হবে অর্থ। এছাড়া মহালয়ার দিন আয়োজন করা হল দুই আনা মূল্যের লটারি খেলাও।
চিত্রকণা থেকে আনা হল কুড়ি ফুটের দুটি বাতিকাঠ। টেবিল টেনিস খেলার স্ক্রীন দিয়ে ঘেরা হল মণ্ডপ। রামচন্দ্র দাসের দায়িত্বে শুরু হল মন্ডপ তৈরি। প্রথম বছর মীর বাজারের দত্ত বাড়ির বন্ধ হয়ে যাওয়া পুজোর প্রতিমার মেড় এনে, মূর্তি তৈরি করা হল। সতীশ দাস তৈরি করলেন চিন্ময়ী মায়ের মৃন্ময়ী রূপ। বিদেশি সাজ পোশাকের বদলে মাটির সাজ পোশাকের রূপ দেওয়া হল। বেশ কিছু বছর পর পুজোর জমি হাতছাড়া হওয়া থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে পড়ে এই পুজো। যা কাটিয়ে উঠতেই ১৯৪৪ সালে সতীশচন্দ্র আঢ্য মারা গেলে নেমে আসে বড় ধাক্কা। নানা সমস্যা কাটিয়ে কর্নেলগোলার ছোট চক অঞ্চলে নতুনভাবে আয়োজিত হয় মূল পুজো (১৯৪৪ সালের পর থেকে)। যা এখনও ওই স্থানেই হয়।
দেবীর মূর্তি গাঢ় হলুদ বর্ণের তৈরি করা হয়। তিলক টানা হয় নাকে। এই প্রতিমার বিশেষত্ব হল, মা দুর্গার দুই পাশে সখী জয়া আর বিজয়া থাকে। পুজোর দ্বিতীয় বছর থেকে মূর্তি তৈরির দায়িত্ব নিলেন মৃৎশিল্পী শচীন পাল ও তাঁর ভাই। পরবর্তীতে বিজয় পাল দীর্ঘ ৪০ বছর এবং তাঁর পুত্র পিন্টু পাল দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে মূর্তি তৈরি করেন। উল্টো রথের দিন কংসাবতী নদীর দুই পাড়ের মাটি এনে তৈরি করা হয় প্রতিমার কাঠামো। পশু বলির বদলে সন্দেশ বলি এবং চালকুমড়ো উৎসর্গের মাধ্যমে এই পুজো সম্পন্ন হয়। প্রতিষ্ঠাতাদের অবর্তমানে পুজোর হাল ধরেন পুলক আঢ্য, স্বপন সিংহ, অজয় মিত্র, নিখিল দাস, রঞ্জিত সিংহ প্রমুখ ব্যক্তিরা।
সরকারের খাতায় ‘মেদিনীপুর জেলার প্রাচীনতম সার্বজনীন দুর্গোৎসব জনকল্যাণ সমিতি’ নামে নথিভুক্ত হয় এই সমিতি। সারাবছর ধরেই কর্নেলগোলার নানা ধরনের সামাজিক কর্মসূচির উদ্যোগ এই সমিতি নিয়ে থাকে। পূর্বের ধারা বজায় রেখে বর্তমান সময়েও কলকাতার বিভিন্ন যাত্রাদল, সঙ্গীত দল এমনকি ব্যান্ডও এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকে। এছাড়া নবমীতে আয়োজিত হয় ডান্ডিয়া খেলা থেকে শুরু করে বিজয়া সম্মিলনী। এই প্রতিমা নাকি জাগ্রত, সবার মনস্কামনা পূরণ করেন। গুজব নাকি সত্য ঘটনা? তা অজানা। এখানে নেই ধর্মের বিভেদ, নেই জাতিভেদ, নেই অর্থনৈতিক বৈষম্য। এই পুজো সকলের পুজো, এই পুজো সার্বজনীন। আর এখানেই এর সফলতা।
চিত্র এবং তথ্য ঋণ – midnapore.in
Discussion about this post