‘‘আরম্ভিছে শীতকাল, পড়িছে নীহার-জাল,/শীর্ণ বৃক্ষশাখা যত ফুলপত্রহীন’’, শীতের শুরুতে প্রকৃতি যতই রিক্ত হয়ে উঠুক, শূন্য হয়ে উঠুক; রবীন্দ্রনাথই কিন্তু আবার বলেছেন, “শীতের হাওয়ায় লাগলো নাচন, আমলকীর এই ডালে ডালে।” অর্থাৎ, এই প্রকৃতিই সানন্দে শীতকে বরণ করে নেয়। শীতের সেই শূন্যতার মধ্যেই হয়ত লুকোনো থাকে পূর্ণতার বীজ। আর অন্যদিকে প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষও শীতের সোনা রোদে গা ভেজাতে বড্ড ভালোবাসেন। কমলালেবু, ঠাকুমা অথবা দিদিমার বোনা পুরনো গন্ধ লেগে থাকা উলের সোয়েটার সমস্তই এই শীতেরই অংশ।
সকাল থেকে দুপুরবেলা মা-দিদিমা-ঠাকুমার বোনা রঙবেরঙের উলের সোয়েটার, টুপি পরা। বাড়ির ছাদ অথবা বারান্দার সেই নির্দিষ্ট কোনে বসা, ঠিক যেখানে রোদ আসে। স্কুলের হোমওয়ার্ক বা ভাইবোনের সঙ্গে খুনসুটি লেগেই থাকা। শীতের সঙ্গে সঙ্গে এইসব পুরনো দিনের গন্ধ মাখা স্মৃতি গড়িয়ে আসে। ভেসে আসে ন্যাপথলিনের গন্ধমাখা পুরনো রঙিন উলের বলগুলি। নিস্তব্ধ দুপুরে উলের কাঁটার খুটখাট শব্দ। হয়ত সেইসব পুরনো সোয়েটার যার বোনা, তিনি আর নেই, অথচ লেগে রয়েছে তাঁর হাতের স্পর্শ। লেগে রয়েছে তাঁর যত্ন, আদর, ভালোবাসা।
শীত পড়তে শুরু করার আগে আগেই কানে আসতো ধুনুরিদের আশ্চর্য যন্ত্রের আওয়াজ। ধুনুরিদের ডাক দিলেই তুলতুলে লেপ তৈরি হয়ে যেত খোলা উঠোনে কিংবা ছাদে। আজ উলবোনা ঠাকুমা, দিদিমাদের মতই চাহিদা মিটে গেছে তাদের। দোকান আর শপিংমলের ঝাঁচকচকে সম্ভার ছেড়ে মানুষ কেনই বা দীর্ঘ সময় ধরে তৈরি করা উলের সোয়েটার পরবে! অন্তত এই আধুনিক যুগে, যেখানে সারা পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে ফ্যাশনের ধারণা, আন্তরিকতার প্রকাশ, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের কেমিস্ট্রি।
বিশ্বযুদ্ধের সময়ে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় সেনাদের পোশাক সরবরাহ করতেন মেয়েরা। সোয়েটার, টুপি, মোজা বুনে পাঠানো হত। কিন্তু এই শীতপোশাকগুলি শুধুই শীতপোশাক ছিল না। এগুলির বুনন বা ডিজাইনের মধ্যে বোনা থাকত গুপ্ত খবরের সংকেত। এছাড়া, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত উল বুনলে নাকি স্বাস্থ্য ভালো থাকে। হতাশা, মানসিক উদ্বেগ কাটাতে সাহায্য করে এই অভ্যেস। সম্প্রতি কিছু বছর আগে, ব্রিটিশ জার্নাল অফ অকুপেশনাল থেরাপিতে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, উল বোনার পর মন বেশ হালকা ও খুশি হয়ে যায় বলে জানিয়েছেন ৮১% মানুষ। এভাবেই নস্টালজিয়া, স্বাস্থ্য, ইতিহাসকে একসঙ্গে বুনে চলেছে রঙিন উল।
Discussion about this post