সকাল হলেই প্রতিদিনের মত ছেনি হাতুড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন মানুষটা। শীত হোক, বা গ্রীষ্ম, রুটিন বাঁধা। কাজের খোঁজে, সকাল থেকে প্রায় রাত্রি পর্যন্ত পায়েই হেঁটে ঘুরে বেড়ান মাইলের পর মাইল পথ। কোনো দিন দিনের শেষে মাত্র একশো বা দুইশ টাকা মত কাজ হয়, কোনদিন আবার আরেকটু বেশি, আর বেশিরভাগ দিন কিছুই হয়না। খালি হাত নিয়েই ফিরতে হয় ঘরে। ঘরে কোনোদিন খাবার হয়, আবার কোনো দিন আধপেটা খেয়ে থাকতে হয়, কখনও সপরিবারে উপোস। কারণ? কারণ তিনি শিল কোটার কাজ করেন।
শিল কোটানোর নামটা চেনা লাগছে? লাগারই কথা। বিশ শতকের আট বা নয়ের দশকে যাঁদের জন্ম, তাঁদের কাছে ‘শিল কাটাও’ বা ‘শিল কাটাবে’র মত সুরেলা ডাকগুলো খুবই পরিচিত ছিল। বিশেষ করে শহর, শহরতলী এবং মফস্বলে এঁদের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। এঁরা মূলত ছেনি, হাতুড়ি দিয়ে বাড়ির শিলনোড়া গুলিকে কেটে কেটে দিতেন। এতে মশলা বাটার কাজ আরও ভালো হত। বেশ কয়েকমাস কেটে গেলেই, শিল কাটাতে আবারও বাড়িতে ডাক পড়ত শিল কাটানোর মানুষের। এঁদের মতই ছিলেন বোঁটি ধার করানোর মানুষেরাও। ধার করার একটা সাইকেলের মত চাকাবিশিষ্ট যন্ত্র কাঁধে নিয়ে তাঁরাও ঘুরতেন এই শিল কাটানোর মতই।
যে পাথরখণ্ডটির উপরে মশলা পেষা হয় সেটি হলো শিল আর যার দ্বারা পেষণ করা হয় সেটি হলো নোড়া। মশলা পেষাইয়ের ফলে শিল এবং নোড়া দুটিই মসৃণ হয়ে যায়। ফলে শিল-কাটা অর্থাৎ শিলের গা অমসৃণ করানো হয়। বর্তমানে বাড়িতে শিলনোড়ায় মশলা বাটার শব্দ প্রায় সোনার পাথর বাটির মত বিষয়। সমস্ত শ্রেণীর মানুষের কাছেই এখন ইলেকট্রনিক মিক্সার, ব্লেন্ডার এবং আরও কত কিছু। এছাড়া, রঙিন প্যাকেটজাত মশলা তো আছেই। আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে, মানুষ অবধারিতভাবেই অনেক কিছুকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছে। নতুনকে গ্রহণ করতে গেলে পুরাতনকে তো বাদ দিতেই হবে! তাই, ‘নো শিলনোড়া’। কিন্তু সে মানুষেরা শিল কাটানোর কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন, তাঁদের অবস্থা কেমন?
‘শিল কাটাও’ বলে ডাক দিয়ে পাড়াময় ঘুরে বেড়াতেন কিছু লোক। এঁরা আদতেই ছিলেন একেকজন যথার্থ শিল্পী। কারণ, শিল অমসৃণ করা শুধু তো অমসৃণ করাই ছিলনা! ছোট্ট হাতুড়ি ও একটি ছোট্ট ছেনী দিয়ে তাঁরা তাঁদের নিপুণ হাতে ঠুকে শিলপাটার ওপর ফুটিয়ে তুলতেন মাছ, পশু, চন্দ্র-সূর্যসহ বিভিন্ন ছবি। শব্দ হত ঠুন ঠুন করে। এই মানুষগুলিকে আজ অন্য পেশার দিকে চলে যেতে হচ্ছে ধীরে ধীরে। তাঁদের শিল্পীমনটি মরে তো যাচ্ছেই, সঙ্গে জীবিকা উপার্জনের পথও গেছে প্রযুক্তি আর আধুনিকতার গোলকধাঁধায় হারিয়ে।
Discussion about this post