বীরেন রায় রোড পশ্চিমে অর্থাৎ যে রাস্তাটি বেহালা চৌরাস্তা থেকে বজবজ ট্রাঙ্ক রোডের সংযোগ বিন্দু নতুন ডাকঘর অবধি বিস্তৃত সেখানে অনেকগুলো বাস রুটের মধ্যে অন্যতম ছিল কলকাতা ভূতল পরিবহণ নিগমের ‘এল ৭বি’ বাস পরিষেবা। এই বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতো ভিন্ন ভিন্ন রুটের বেসরকারি বাস সহ দু’দুটো মিনিবাসও। বেহালা শিবরামপুরের অক্সিটাউন থেকে সারাদিনে কয়েক দফা চলতো এই সরকারি বাসটি যার নামডাক ছিল তার গতির জন্য। মূলতঃ অফিস কাছারির মানুষজনের কাছে এল-৭বি বাস ছিল চোখের মণি। সমান্তরালে একই প্রান্তিক স্টপেজ থেকে ১২সি/১ রুটের বাসও চলতো কিন্তু সরকারি বাসের ‘ডোন্ট কেয়ার’ হাবভাবের সামনে পরিষেবা ছিল অতি জঘন্য। তুলনা করলে বলা চলে অন্যান্য বাসের সামনে এল-৭বি সেই যুগে টি-২০ এর গতিতে চলতো। চলতো না, বরং উড়তো।
‘এল-৭বি’ র রুট ছিল ভারী চমৎকার। শিবরামপুর থেকে শকুন্তলা পার্ক, বকুলতলা পেরিয়ে বেহালা চৌরাস্তা থেকে ভায়া বেহালা পৌঁছে যেত তারাতলা পেরিয়ে মোমিনপুর। সেখান থেকে ডানদিক নিয়ে লালবাতির মোড় পেরিয়ে হাজরা। হাজরা মোড় থেকে হরিশ মুখার্জি রোড ধরে চৌরঙ্গী, শেষে বিবাদি বাগ হয়ে ধর্মতলা। ভবানী ভবন, আলিপুর কোর্ট বা ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরের অফিস; দক্ষিণ কলকাতায় অবস্থিত নানা অফিস, কলেজ বা স্কুলের জন্য এল-৭বি ছিল শ্রীযুক্ত নির্ভরযোগ্য। সকাল থেকে টাইম টেবিলে সড়গড় বাবুরা, কেরানিরা, ছাত্র-ছাত্রীরা লম্বা লাইনে অপেক্ষায় থাকতো বাসের সিট পাওয়ার জন্য। রোজকার যাত্রার সৌজন্যে একটা পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বৈকি। যেমন চলতো সারা রাস্তা জুড়ে খুনসুটি, তেমনই ভিড়ের মধ্যে অল্প বিস্তর ঝুট-ঝামেলাও লেগে থাকতো। তবে অক্সিটাউন থেকে ওঠা নিত্যযাত্রীদের একটা দুর্দান্ত অধিকারবোধ কাজ করতো। প্রাত্যহিক ঝামেলার চলন্ত সালিশি সভার মোক্তার হয়ে উঠতেন তাঁরা।
প্রাক-মোবাইল যুগে কথার কারিগরি ও আতসবাজি সারা রাস্তা জুড়ে চলতো। সবাই সবার গন্তব্য মুখস্থ করে রাখতেন। জানালার ধারে মৃদুমন্দ বাতাসের দোলায় ভাত ঘুমে ঢুলে পড়া সহযাত্রীকে সযত্নে ডেকে দেওয়ারও অলিখিত প্রথাও ছিল সকলের রপ্ত। গল্প গুজবে সংবাদের শিরোনাম নিয়ে ‘টক শো’ চলতো দেদার। বাসের সঙ্গে পাল্লা দিতে আসা অন্য বাসের বীরত্বকে মাটিতে মেশানোর একটা অপ্রতিরোধ্য প্রতিযোগিতাও চলতো হামেশাই। ভালোবেসে এল-৭বি রুটের বাসের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘রোড কিং।’
কলকাতার সরকারি পরিবহণ ব্যবস্থার অবনতি, আর্থিক দুরাবস্থা, কর্মী সংকট বা বিকল্প যানবাহন হিসেবে অটোর হাঁকডাক এক সময় এই দুরন্ত বাসের জৌলুস অনেকটাই কেড়ে নেয়। অঞ্চলের বাসিন্দারা অধিকাংশই এখন অটো নির্ভর। অতীতের এল-৭বি অনেকেরই আজ শুধু স্মৃতিতেই উজ্জ্বল।
Discussion about this post