চিরসবুজ পাইন গাছের ছায়া, মেঘ ছুঁয়ে ফেলা ঢালু পাহাড়, নিচে ফজর্ডের স্বচ্ছ নীল জলরাশি, তার ওপরে পাথরের তৈরি প্রাকৃতিক চাতাল—আয়তাকার, প্রান্তে ছিদ্র, যেন পুরাণের কোনো নর্স দেবতা নিজ হাতে খোদাই করেছেন। চারপাশে পাহাড়ি হ্রদ আর হিমেল বাতাসে কুয়াশার চাদর। একটি সরু পথ মালভূমি পেরিয়ে দাঁড়িয়েছে কিনারায়। এই যেন পৃথিবীর কিনারা, আর অপার্থিব জগতের শুরু। নরওয়ে, এক আশ্চর্য দেশ, আর সেই দেশেরই এই জায়গায় পৌঁছনোর রাস্তাটি করে দিয়েছেন নেপালি শেরপার দল!
হ্যাঁ! এই নিসর্গ নরওয়ের একার নয়। বিস্ময়করভাবে এর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন হিমালয়ের সন্তান, নেপালের শেরপারা। নরওয়ের প্রায় ৩০০টিরও বেশি পাথরের সিঁড়ি তৈরির নেপথ্যে আছেন মাউন্ট এভারেস্টের পাদদেশে বসবাসকারী এই মানুষগুলি। বার্গেন শহরের উলরিকেন পাহাড় হোক বা বিখ্যাত প্রিকেস্টোলেন, তাঁরা কেবল সিঁড়ি বানাননি, বানিয়েছেন পার্বত্য সংস্কৃতির এক নতুন সেতু। সেই সেতু নর্ডিক উত্তর আর হিমালয়ীয় পূর্বের মধ্যেকার সেতু।
এই অবাক করা উদ্যোগের পেছনে ছিলেন একদল নরওয়েজিয়ান প্রকৌশলী ও পরিবেশবিদ। তাঁরা তাঁদের হিমালয়-সফরের সময় শেরপাদের দক্ষতা, সহনশীলতা দেখে অবাক হয়েছিলেন। পাহাড়ে ভারসাম্য রেখে শত শত কিলো পাথর নিয়ে কাজ করার মতো সহ্যশক্তি এবং ধৈর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে, তাঁরা শেরপাদের আমন্ত্রণ জানান নরওয়েতে। শেরপারা এসে স্থানীয় পাথর ব্যবহার করে এমনভাবে সিঁড়ি তৈরি করেন যা প্রকৃতির সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ, এবং হাজার হাজার মানুষকে নিরাপদে উপরে উঠতে সাহায্য করে।
শেরপাদের বানানো সিঁড়িগুলি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে বৃষ্টির জল নিচে গড়িয়ে যায়, কিন্তু পাথরের ক্ষয় না হয়। এই কৌশল তাঁরা হিমালয়বাসের অভিজ্ঞতা থেকে শিখে প্রয়োগ করেছেন। ২০১৯ সালে প্রিকেস্টোলেনে প্রায় ৩,৩১,০০০ মানুষ হাইকিং করেছেন, যার সংখ্যা ২০২৫-এর মধ্যে ৬০০,০০০-এ পৌঁছাতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সবই সম্ভব হয়েছে, কারণ নরওয়ে আর নেপালের মাঝে এক অলক্ষ্য বন্ধনের জন্ম হয়েছে। যেন একটি পাহাড় আরেকটি পাহাড়কে চিনেছে।
Discussion about this post