জার্মান নাৎসী বাহিনীর রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক ব্রিটিশ তরুণী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ব্রিটেনের ‘স্পেশাল অপারেশনস এক্সিকিউটিভ’-এর অন্যতম এক সদস্যা। অসীম সাহসিকতার জন্য তিনি পান ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান। সেইসময় তাঁর নামাঙ্কিত নোট ও ডাকটিকিটও প্রকাশ পেয়েছিল। এমনকি তাঁর জীবন অবলম্বন করে তৈরী হয়েছে জেমস বন্ডের মতো হলিউড সিনেমাও। অথচ তাঁর কাহিনী বহু ভারতীয়র কাছে প্রায় অজানাই থেকে গিয়েছে। তিনি হলেন নূর ইনায়েত খান, ‘On Her Majesty’s secret services’ এর প্রথম মহিলা গুপ্তচর।
নূরের বাবা এনায়েত খান ছিলেন বরোদা রাজ্যের এক নামকরা সুফি সাধক। এক সময় ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি আমেরিকায় আসেন। সেখানেই সান ফ্রান্সিসকোতে এক মার্কিন মহিলার সঙ্গে তাঁর আলাপ হয় এবং শেষ পর্যন্ত তাকে বিয়েও করেন। বিয়ের পর জারের আমন্ত্রণে সস্ত্রীক মস্কোয় যান তিনি। ১৯১৪ সালে মস্কোতেই জন্ম হয় তাঁর প্রথম কন্যা সন্তানের। প্রথম সন্তান বলে আদর করে তার নাম রাখেন ‘নূর’। নূরের জন্মের কয়েক মাস পরেই রাশিয়ায় বলশেভিক বিদ্রোহ শুরু হয়। এর সঙ্গে সমান তালে চলে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এই অবস্থায় এনায়েত খান প্যারিসে চলে আসেন। এই প্যারিসেই নূরের ছাত্রী জীবনের শুরু। পড়াশোনার সঙ্গে নিয়মিত গানের চর্চাও শুরু করেন নূর। বেশ ভালই কাটছিল দিনকাল, হঠাৎ তেরো বছর বয়সে দু’দিনের জ্বরে মারা গেলেন তার বাবা। নূর সহ চার ভাই বোনকে নিয়ে সংসার সামলাতে তখন প্রায় অসহায় অবস্থা তার মায়ের। এই সময় মাকে সাহায্য করতে নূর রেডিও প্যারিসে গান গাইতে শুরু করলেন। সঙ্গে ছিল শিশুদের বই ও নাটক লেখার কাজও। বাবা ছিলেন উচ্চস্তরের সঙ্গীতজ্ঞ তাই গান তাঁর রক্তেই ছিল। গানের জগতে অচিরেই বেশ নামডাক হলো নূরের।
এরপর শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। নাৎসী ফৌজ প্যারিস দখল করে নেয়। সেইসময় মা আর ভাইবোনদের নিয়ে ইংল্যান্ডে পালিয়ে এলেন নূর। সেখানে এসে তার ভাই বিলায়েত রয়্যাল এয়ার ফোর্সে যোগ দেয়। নূর নিজে যোগদান করেন উওমেন’স অক্সিলারী এয়ার ফোর্সে, প্রথম মহিলা শিক্ষানবিশী হিসাবে । ১৯৪১ সালে তাঁকে নিয়ে আসা হয় অ্যাবিংডন বম্বার কম্যান্ডে। সেখানে তাঁকে স্পেশাল অপারেশনস এক্সিকিউটিভ (SOE) বাহিনীর সদস্য রূপে মারণাস্ত্র, বিস্ফোরক ও ধ্বংসাত্মক কাজের বিশেষ ট্রেনিংও দেওয়া হয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যে সাংকেতিক যোগাযোগ ও বিনা অস্ত্রে হত্যার কৌশলও শিখে ফেলেন নূর। প্রায় দেড় বছর পর একদিন রাতের অন্ধকারে বিমান থেকে প্যারাশুটে করে তাঁকে ফরাসী উপকূলে নামিয়ে দেয়া হল। নোরা ম্যাডেলিন পরিচয়ে SOE এর প্রথম মহিলা এজেন্ট হিসাবে ফ্রান্সে ঢুকলেন নূর ইনায়েত খান। প্রায় তিন মাস ধরে বেতারের মাধ্যমে তিনি জার্মান সেনার অবস্থান মিত্রবাহিনীর দপ্তরে জানিয়ে গেলেন। ক্রমাগত অবস্থান বদলাতে থাকায় নাৎসী বাহিনী তাঁর টিঁকিটিও ছুঁতে পারল না। অনর্গল ফরাসী ভাষা বলতে পারতেন তিনি। সেই জন্য কিছু বাড়তি সুবিধাও পেয়ে যেতেন।
শেষ পর্যন্ত এক ফরাসী ডবল এজেন্টের বিশ্বাসঘাতকতায় জার্মান পুলিশ বাহিনী গেস্টাপোর হাতে ধরা পড়লেন তিনি। তাঁর ওপরে শুরু হল অমানুষিক অত্যাচার। তবুও একটা কথাও তাঁর মুখ থেকে কথা বের করা যায়নি। অবশেষে জার্মানির এক কারাগারে তাঁকে বন্দী করে রাখা হল। সেখানে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হত তাঁকে। অকথ্য অত্যাচারে মস্তিষ্কের বিকৃতি দেখা দিল তাঁর। অবশেষে ১৯৪৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মাত্র তিরিশ বছর বয়সে ডাচাউ জেলে গুলি করে হত্যা করা হয় তাঁকে। তাঁর এই অভূতপূর্ব সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের জন্য ফরাসী সরকার তাঁকে মরণোত্তর ‘Croix de Guerre’ সম্মানে ভূষিত করে। এছাড়াও বৃটিশ সরকার তাঁকে ‘George Cross’ সম্মান দান করে। ২০১২ সালে লন্ডনের গর্ডন স্কোয়ারে নূর ইনায়েত খানের মূর্তির উন্মোচনও করেন স্বয়ং রাণী এলিজাবেথ। ভারতীয় নারীদের অবলা বলে মেনে আসা বিদেশি মানুষজনের ভুল ধারণা এক নিমেষে ভেঙে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁদের কাছ থেকেও অসীম শ্রদ্ধা কুড়িয়েছিলেন লৌহমানবী নূর ইনায়েত খান।
Discussion about this post