ফোন কথাটা শুনলেই চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ডের গানের একটি লাইন মনে পড়ে যায়। “ফোন হবে নোকিয়া, প্রেম পরকীয়া।” লাইনটি কার্যত স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয় ফোন মানেই একটা সময় শুধু নোকিয়া ছিল। আর নোকিয়া নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা কিপ্যাড ফোন, যার ব্যাটারি চার্জ দেওয়ার জন্য খুব বিশেষ চিন্তা না করলেও চলত। আমরা সবাই কখনও না কখনও নোকিয়ার ফোন ব্যবহার করেছি। একটি গোটা প্রজন্মের বেশিরভাগেরই প্রথম ফোনটি ছিল নোকিয়ার। গত দেড়শো বছর ধরে গ্রাহক সেবায় পথ চলছে ফিনল্যান্ডের এই সংস্থা। তবে নোকিয়ার পথ চলা শুরু হয়েছিল একটি কাগজের মিল হিসেবে। এরপর নোকিয়া ধীরে ধীরে নিজেকে বহুমাত্রিক সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। কাগজ মিলের পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারী সংস্থা হিসেবে সংস্থাটি কাজ শুরু করে। এরপর ১৯৭০-এর দিকে নোকিয়া শুরু করে নেটওয়ার্কিং ও রেডিওর ব্যাবসা। বিশ্ব বাজারে তারা মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেশন হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করে।
এরপরই নোকিয়া সিদ্ধান্ত নেয় একটি মোবাইল সেট তৈরি করার যেটি বহনযোগ্য অর্থাৎ অনায়াসে বয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী নোকিয়া ‘মবিরা’ নামের এক টেলিফোন নির্মাতা সংস্থাকে কিনে নেয়। এরপর ইনুকে তৈরি করে ১৯৮২ সালে ‘নোকিয়া মোবিরা সেনেটার’ নামে একটি ফোন। এটিই ছিল পৃথিবীর প্রথম বহনযোগ্য ফোন, যার ওজন ছিল ১০ কিলো। ঠিক তার দু’বছর পর নোকিয়া ১৯৮৪ সালে বাণিজ্যিকভাবে ‘নোকিয়া মোবিরা টক ম্যান’ নামে একটি অন্য একটি বহনযোগ্য ফোন লঞ্চ করে। যার ওজন ছিল ৫ কিলো। এর পর ধীরে ধীরে নোকিয়া ফোনের বিবর্তন আনতে শুরু করলে ফোনের ওজন কমতে কমতে দাঁড়ায় মাত্র ৮০০ গ্রাম। ১৯৯২ সালে তাঁরা ১০১১ নামক একটি ফোন আনে বাজারে যার দরুন বিশ্ব বাজারে তাদের পরিচিত ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যেই নোকিয়া তার প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বী ‘মোটোরোলা’কে টপকিয়ে বিশ্ব বাজারের শীর্ষে এসে পৌঁছোয়। ১৯৯৬-১৯৯৮ সালে নোকিয়া চিন, আমেরিকা, রাশিয়া এবং ভারতের বাজারে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সেই সময় পৃথিবীর সেরা ৫০ টি মোবাইলের মধ্যে ২০ টিই নোকিয়ার হতো। নোকিয়া আর তার নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম ‘সিম্বিয়ান’ যখন বাজারে একচেটিয়া রাজ করছে। ঠিক সেই সময় আমেরিকা ও ইউরোপের মার্কেটে আসতে শুরু করে অ্যাপেলের আইওএস এবং গুগলের অ্যান্ড্রয়েড সিস্টেম।
নোকিয়া ক্রেতাদের ভালো হার্ডওয়ার দিতে গিয়ে নজর দিল না সফটওয়ারের দিকে। কিন্তু ততদিনে হার্ডওয়ারকে ছাপিয়ে গিয়ে ক্রেতারা ক্রমশ সফটওয়্যারমুখী হয়ে উঠেছেন। এবং অ্যান্ড্রয়েড নিজস্ব আকর্ষণীয় অপারেটিং সিস্টেমের মাধ্যমে বাজার কেড়ে নিল নোকিয়ার। যেখানে আইওএসের কাছে তিন লক্ষ, গুগলের কাছে দেড় লক্ষ অ্যাপ্লিকেশন ছিল, সেখানে নোকিয়ার কাছে ছিল মাত্র কুড়ি হাজার অ্যাপ্লিকেশন। নিত্যনতুন অ্যাপ্লিকেশনের টানে ধীরে ধীরে স্যামসাং, মোটোরোলা বাজার ধরতে শুরু করল। নোকিয়া তখনও অ্যান্ড্রয়েডের মতো একটি বড় ইকোসিস্টেমে না ঢুকে পুরোপুরি হারিয়ে ফেললো নিজের মার্কেট।
এরপর নড়ল নোকিয়ার টনক। বাজারে নতুন স্বাদের কিছু এনে অ্যান্ড্রয়েডকে টেক্কা দেওয়ার জন্যই নিজস্ব সিম্বিয়ান সিস্টেমকে বাদ দিয়ে হাত মেলালো উইন্ডোজের সাথে। নোকিয়ার ভরসা ছিল নিজের হার্ডওয়ারের উপর। কিন্তু উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম কখনোই মোবাইল ডিভাইসের জন্যে কম্প্যাটিবল না থাকায় পুনরায় ধাক্কা খায় নোকিয়ার উইন্ডোজ সিরিজের ফোন ‘নোকিয়া লুমিয়া’। এরপর নিজের জমি আর ধরে রাখতে পারেনি নোকিয়া। বিশ্ব বাজারের এক নম্বর সংস্থার হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।
যদিও এত বাধা কাটিয়ে নোকিয়া আবার ঘুরে দাঁড়ায় ২০১৪ সালে, নিয়ে আসে নিজের প্রথম অ্যান্ড্রয়েড ফোন ‘নোকিয়া এক্স ২’। বর্তমান বাজারে বাকি অ্যান্ড্রয়েড ফোনের চাহিদা অনুযায়ী নোকিয়া ফিরতে পারেনি সেভাবে। তবে একটি কাগজ কল থেকে একেবারে বিশ্ব বাজারের এক নম্বর সংস্থা হাওয়ার দরুন সম্পূর্ণ স্রোতের বিপরীতে হেঁটে নজির সে ঠিকই গড়েছে। ব্যর্থ হলেও মাবাজারে আজও টিকে আছে নোকিয়া। আজও সে রয়েছে ‘স্নেকস’, ‘বাবল’ খেলতে শেখানো এক অদ্ভুত নস্টালজিক স্মৃতি হয়ে।
কলমে অর্পিতা দে
Discussion about this post