“লৌহে বৃদ্ধি রক্তকণা/শঙ্খে বৃদ্ধি হাড়/সিঁদুরেতে শোভা বৃদ্ধি/বন্ধ্যার প্রতিকার।”- পলাশ পোড়েলের সেই প্রবাদ! ভারতীয় হিন্দু শাস্ত্র মতে বিবাহিত মহিলাদের জীবনে যেমন শাঁখা-সিঁদুর গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমনই নোয়ারও যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। এই নোয়া শিল্পের চল রয়েছে হাওড়ার উদয়নারায়ণপুর থানার অন্তর্গত কয়েকটি গ্রামে। বিশেষ করে কুড়চি-শিবপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত গজা গ্রামে এই শিল্প দেখা যায়। হাওড়ার গজা গ্রাম দামোদর নদের তীরে অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম। কুম্ভমেলা, গঙ্গাসাগর মেলা থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মেলায় এই গ্রামের তৈরি নোয়া মিলবেই।
এই গ্রামের নোয়া শিল্প প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো। গ্রামের একাংশ পরিবারের পেশা নোয়া তৈরি। বাড়িতে বাড়িতে স্তূপ করে রাখা গোলাকার অ্যালুমিনিয়াম তার, ছোট চারকোণ যুক্ত একটা লোহার পাত, কাঠের গোলাকার বস্তু – এই সবই নোয়া তৈরির সরঞ্জাম। কমপক্ষে ৩০ রকমের ডিজাইন নোয়া তৈরি হয় এখানে। শিল্পীরা বিস্কুট, মাছের চোখ, রুইতান, লতা-সহ বিভিন্ন ডিজাইনের নোয়া তৈরি করেন। মাপের দিক থেকে ৬-৮-১০-১২-১৪-১৬-১৮-২০-২২ আনা। এই নোয়াগুলি কলকাতার বেহালায় পাঠানো হয়, সেখানে রং করে তা চলে যায় বিভিন্ন এলাকায়।
বর্তমানে বড়বাজার থেকে পেটাতার কিনে নোয়া তৈরি করা হয়। মূলতঃ এটি তৈরিতে ব্যবহার করা হয় লোহা ও পিতল। এক সময় অ্যালুমিনিয়ামেরও নোয়া তৈরি হত। তবে বর্তমানে ঐ ধাতুর নোয়া ব্যবহার লুপ্তপ্রায়। গ্রামের গোস্বামী বাড়ি এখন এই শিল্পের প্রধান কেন্দ্র। এঁনারা প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ বছর ধরে পিতৃ-পিতামহের আমল থেকে এই শিল্পের সাথে যুক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তবে একসময় গ্রামের ৫-৭টি ঘর এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এখন প্রায় দেড়-দু’শ ঘরর নারী পুরুষ সকলেই এই পেশায় যুক্ত।
গজা গ্রামের নোয়া শিল্পীরা দীর্ঘদিন ধরে এই কাজ করে আসছেন। বাবা থেকে ছেলে এই শিল্পের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। কিন্তু এই গ্রামে অভাবের ছাপ স্পষ্ট। বানের জল এসে প্রায়ই এলাকা ডুবিয়ে দেয়। শিল্পীদের দাবি, তারা কাজের যথাযথ মূল্য পাচ্ছেন না। এই গ্রামের নোয়া শিল্প কেবলমাত্র একটি শিল্পই নয়, এটি একটি ঐতিহ্য। তাই এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং এই শিল্পীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন। এই গ্রামের নোয়া শিল্পকে সারা বিশ্বে পরিচিত করার জন্যও পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ। সার্বিকভাবে বলতে গেলে, হাওড়ার গজা গ্রামের নোয়া শিল্প ভারতীয় হস্তশিল্পের একটি অমূল্য সম্পদ। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – পপি তালুকদার
Discussion about this post