এক সময়ের অখ্যাত তিনটে গ্রাম সুতানটী, গোবিন্দপুর আর কলকাতা নিয়ে গড়ে ওঠা নগর কখন যে ধীরে ধীরে মহানগরী হয়ে উঠেছে। আর সেখানেই বহু ইতিহাসের সাক্ষী নানান উপাসনালয়ের ভাঙা গড়ার গল্পের আকারে বেড়ে উঠেছে আপন খেয়ালে। তার আগে কলকাতার বুকে কীভাবে মসজিদ স্থাপনের সূচনা হল, তা জানা যাক। কলকাতার বুকে যে সব প্রাচীন মসজিদ তৈরী হয়েছিল তা সবই প্রায় ব্রিটিশ আমলে। জানা যায়, ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে নবাব সিরাজদৌল্লার কলকাতা দখলের সময় তাঁর সৈন্যবাহিনীর বহু মানুষ জন এখানে আসেন। পরবর্তী সময়ে নবাব চলে গেলেও তারা থেকে যান। আবার এটাও অনুমান করা হয় ইংরেজ শাসকের দ্বারা টিপু সুলতানের বংশধর নবাব ওয়াজিদ আলী শাহকে কলকাতায় নির্বাসিত করা হয়। স্বাভাবিক ভাবেই এই দুই কারণে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তার ফল স্বরূপ উনিশ শতকের আগে থেকে বা পরবর্তী সময় কাল থেকে কলকাতার বুকে মসজিদ নির্মাণ শুরু হয়।
এই ২০২১ এ মহামানবের মিলনের ঐক্য হিসাবে রয়েছে নিমতলা ঘাট স্ট্রিটের পশ্চিম প্রান্তের সুউচ্চ নয়টি গম্বুজের এই মসজিদটা। এর পশ্চিমে রয়েছে আনন্দময়ী কালী আর পূর্বে রয়েছে দুর্গেশ্বর শিবের আটচালা মন্দির। নাম নিয়ামাতুল্লা ঘাট মসজিদ। যার বর্তমানে এর ঠিকানা ৮৬/১ নিমতলা ঘাট স্ট্রিট। মহম্মদ রমজান আলী ছিলেন ওই অঞ্চলের প্রধান জমিদার। তিনিই এই মসজিদের স্থপতি। তাঁর নামেই কাছাকাছি রাস্তার নাম মহম্মদ রমজান লেন।
যদিও কলকাতা বিষয়ে অন্যতম ঐতিহাসিক প্রাণকৃষ্ণ দত্তের মতে রমজানের পূর্ব পুরুষেরা খুবই প্রাচীন অধিবাসী। তারা, দত্ত চৌধুরীদের আসার বহু পূর্বে এখানে এসেছেন। এক সময় এই মসজিদের পাশ দিয়ে ভাগীরথী প্রবাহিত হওয়াতে রমজানের পূর্বপুরুষ নিয়ামাতুল্লা স্নান করার জন্য একটা ঘাট তৈরী করেন। পরবর্তী কালে নদী পশ্চিম দিকে সরে যাওয়ায় ঘাট সেখানে বিলুপ্ত হয়। তার পাশে এই মসজিদ নির্মিত হয়। রমজানের পূর্বপুরুষ দ্বারা নির্মিত ঘাট সম্পর্কে একটা বিষয় লক্ষণীয় ছিল যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও এই ঘাট স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করত। ঐতিহাসিক প্রাণকৃষ্ণ দত্ত ধার্মিক রমজানের উদার মনের প্রসঙ্গে একটা ঘটনা উল্লেখ করেছেন যে রমজানের বাড়ির ছেলেরা একদিন ওই ঘাটে স্নান করছিল, সেই সময় ব্রাহ্মণরা স্নান শেষে পুজো করছিল। অসাবধানতা বশত তাঁদের গায়ে জল লেগে যায়। ব্রাহ্মণ রা বলে ওঠেন, মুসলমানের ঘাটে হিন্দুর স্নান-পুজো করবার এই ফল, চল আবার অন্য ঘাটে গিয়ে পুজো করা হোক। এই ঘটনা রমজানের কানে পৌঁছাতে উনি প্রহরী নিযুক্ত করে আদেশ দেন যে কোন মুসলিম মানুষ ওই ঘাটে স্নান করতে আপাতত পারবে না। এই ভাবে রমজান একটা সম্প্রীতির অবস্থানকে ধরে রেখেছিলেন।
এবার ওই মসজিদের স্থাপত্য শিল্পের দিকে নজর দেওয়া যাক। বর্তমানে এই মসজিদের ছাদ যে গম্বুজ দিয়ে তৈরী তা ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে খুব মনোগ্রাহী স্থাপত্য কৌশলের নির্দশন পাওয়া যায়। মসজিদটির পূর্ব, উত্তর, দক্ষিণে খিলান যুক্ত সমদূরত্বে তিনটে করে প্রবেশদ্বার রয়েছে। এই মসজিদের প্রতিটা প্রবেশপথে দরজার নিচেও রয়েছে কষ্টিপাথরের চৌকাঠ। আরও একটা উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়। স্থানীয় মতোয়ালীদের মতে এই মসজিদ তৈরীর সময় দরজায় ব্যবহৃত পাথর গুলো গৌড় থেকে আনা হয়। এই মসজিদের কোন প্রতিষ্ঠালিপি নেই। তবে ১৮৯৬ সালে তৈরী এক তালিকা এবং ইংরেজি অনুবাদে উল্লেখিত হয়েছে যে এই মসজিদটা ১১৯৯ হিজরায় (১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে) তৈরী হয়। এখনও আমরা ধর্মকে শিখন্ডী করে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দেখি। সত্যি কি সেটা কাম্য? কোরান হোক বা গীতা! কোথাও শুধু ধর্মের নামে মানুষে মানুষে দাঙ্গাকে প্রশয় দেওয়া হয় নি। আসলে আমাদের ভাবনা আর চিন্তার এখনও উত্তরণ বাকি রয়েছে। সেই শিক্ষাই হয়তো দিয়ে যায় এই বহু শতাব্দী প্রাচীন ইমারতগুলি।
চিত্র ঋণ – double dolphin blogspot
Discussion about this post