কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেল। এরপরেই শুনতে পাওয়া যাবে,”জিঙ্গল বেল, জিঙ্গল বেল” সুরটা। চার্চগুলো ভরে উঠবে তখন মোহময়ী আলোর রোশনাইতে। খাওয়ার থালা ভরে উঠবে লোভনীয় সব কেক প্যাটিসে। সারাবছর কেকের স্বাদ আর বড়দিনের কেকের স্বাদের হেরফের কিন্তু অনেকটা। কারণ একটাই, উৎসবী আবেগ যে মিশে থাকে ক্রিসমাস কেকে। শহর, মফঃস্বল এমনকি গ্রামের অলিগলিতে দোকানের সামনেই সেজে ওঠে রকমারি কেকের পসরা। তাই ডিসেম্বরের শুরু থেকেই বেকারিগুলির যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চলে প্রস্তুতি।
নিউ মার্কটের অন্দরমহল। একটু এগোলেই দূর থেকে একটা মিষ্টি গন্ধের আবেশ। আরও খানিকটা এগিয়ে কাচ ঘেরা এক দোকান। জৌলুস বিশেষ নেই, পুরনো ধাঁচটাই এর বিশেষত্ব বলা যায়। ১১৮ বছরের পুরনো হলেও, আভিজাত্যে এখনও ভরপুর এটি। কালো সেগুন কাঠের আসবাব। শো-কেসের পালিশেও বেশ সাবেকি ছোঁয়া। জিঙ্ক প্যানেলের ইতালিয়ান ডেকরেটিভ সিলিং। মাথার ওপর জ্বলজ্বল করছে নামের প্ল্যাকার্ডটা। নাহুম অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড। ভেতরে ঢুকলেই নজরে পড়বে কেক, পেস্ট্রি, চিজ, কেক। তবে এই দোকানের কেকে শুধু ইতিহাস মাখানোই নয়, রয়েছে সম্প্রীতির সুবাসও। এখানে কেকের কারিগররা মুসলিম, দোকানের মালিক ইহুদী যারা খ্রীষ্টান ধর্মের সবচেয়ে বড় উৎসবকে লক্ষ্য করে বিশেষ ধরনের কেক বিক্রি করেন।
তখন উনিশ শতক। কলকাতায় এলেন অনামী এক ইহুদি যুবক। নাহুম ইজরায়েল মোরদেকাই। এক অনিশ্চয়তার ভবিষ্যৎ। শুধুমাত্র পারিবারিক খাবারের কৌশলটুকুই সম্বল। সেই নিয়েই নেমে পড়লেন কলকাতার রাস্তায়। হগ সাহেবের বাজারের পাশে একটা ছোট্ট দোকান শুরু করলেন। সালটা তখন ১৯০২। নিজেই তৈরি করলেন চিজ, কেক, পাউরুটি, পেস্ট্রি। বাড়ি বাড়ি ফেরিও করতেন সেসব। কলকাতা নগরীকে অচেনা এক স্বাদে ভুলিয়ে দিলেন নাহুম ইজরায়েল। তীব্র ব্যস্ততার মাঝে নাহুমসের বর্তমান কর্ণধার জেসিকা ব্যাপটিস্ট ক্রেতাদের ব্যালেন্স ফেরৎ দিতে দিতেই খানিক সময় দিলেন ‘ডেইলি নিউজ রিল’কে। তাদের কেক ভাণ্ডারে থাকা বিপুল বৈচিত্র্যের কথা জানা গেল। ৪০০ গ্রাম ওজনের প্লাম কেকের দাম পড়বে ২৮০ টাকা। স্পেশ্যাল ফ্রুট কেকের জন্য পকেটের রেস্ত থাকতে হবে ৫০০ টাকা। এছাড়াও ৩৪০ টাকা দামেরও ফ্রুট কেক পাওয়া যাচ্ছে। এবার ধরা যাক, আপনার বাজেট অতি সামান্য কিন্তু নাহুমসের কেককে অন্ততঃ একবারের জন্য ছুঁয়ে দেখতে চায় আপনার জিভ। আজ্ঞে, তারও উপায় রয়েছে। মাত্র ৩৫ টাকাতেই মিলছে স্লাইস পাম কেক।
শতাব্দী বদলালেও, বাঙালির স্বাদ বদলায়নি। ঝকঝকে প্যাকেজিংয়ের যুগে নাহুমস এখনও কাগজের বক্সেই ঘরে ঢোকে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে শুরু করে বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ থেকে সবুজ বিপ্লব। সবই দেখেছে নাহুমস। তবে এতো কিছুর পরেও ইহুদি সাহেবের কেকের দোকানটি কিন্তু তার আভিজাত্য বজায় রেখে রয়ে গিয়েছে একইরকম। এই দোকানের কেক মানুষ শুধু জিভ দিয়েই নয়, চিনেছে নস্টালজিয়া দিয়েও।
Discussion about this post