চারিদিকে যখন জানুয়ারির হাড় হিম করা ঠান্ডা। বাঙালি তখন মেতে ওঠে বই মেলা, কৃষি মেলা, পিঠে মেলাতে। তবে এই সব মেলার থেকে ব্যাতিক্রম মুড়ি মেলার নাম শুনেছেন কখনও? মুড়ি, বাঙালির সকাল-সন্ধ্যার নিত্যসঙ্গী। বাঙালির ঘরে আর যা থাকুক বা না থাকুক, মুড়ি কিন্তু থাকবেই। জানা যায়, বৈদিক যুগে দেবতাদের জন্য যজ্ঞের নৈবেদ্য পাঠানো হতো সেখানেও চালভাজার স্থান ছিলো। এই চালভাজাই মুড়ি। আর এই মুড়িকে কেন্দ্র করে একটি মেলা।
কেঞ্জাকুড়া, বাঁকুড়ার শিল্প গ্রাম নামে পরিচিত। গ্রামকে তিন দিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে দারকেশ্বর নদী। কাঁসা পিতল, বাঁশের খেলনা ও তাঁতের গামছা শিল্পর জন্য প্রসিদ্ধ বাঁকুড়ার কেঞ্জাকুড়া। গ্রামের পশ্চিমে নদীর তীরে শ্রী শ্রী সঞ্জীবনী মাতা আশ্রম। এই সঞ্জীবনী আশ্রমেই প্রতি বছর ১-৩ মাঘ পর্যন্ত চব্বিশ প্রহর নাম সংকীর্তনের মাধ্যমে মুড়ি মেলার সূচনা ঘটে । পরের দিন ৪ঠা মাঘ, মুড়ি মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
স্থানীয়রা জানান, এক সময় এই এলাকা ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা। দূর দূরান্ত থেকে ভক্তরা হরিনাম শুনতে আসতেন ওই আশ্রমে। তবে হিংস্র জীবজন্তুর আক্রমনের ভয়ে রাতে তাঁরা নিজেদের গ্রামে ফিরতে পারতেন না। সারারাত জেগে নামগান শুনে পরের দিন সকালে দ্বারকেশ্বরের জলে নিজেদের সঙ্গে থাকা মুড়ি ভিজিয়ে খেয়ে বাড়ি ফিরতেন। ধীরে ধীরে ভক্তদের সেই মুড়ি খাওয়ার রেওয়াজ পরিণত হয়েছে উৎসবে।
মুড়ি মেলার দিন সকাল থেকেই আশেপাশের অঞ্চল থেকে হাজার হাজার মুড়িপ্রেমী ভিড় করতে থাকেন এই মেলাতে। মুড়ি, চানাচুর, চপ, বেগুনি, ঘুগনি, লঙ্কা, শশা, পেঁয়াজ, ধনেপাতা, জিলিপি, বিভিন্ন ধরনের নাড়ু নিয়ে সকলে হাজির হন নদী চরে। সঙ্গে ছড়িয়ে দেওয়া হয় লাল লঙ্কার ঝাল চাটনি। বিভিন্ন ভাজার গন্ধে ভরপুর হয়ে ওঠে গোটা মেলা চত্ত্বর। এবার সকলে মিলে একসাথে শুরু হয় মুড়ি খাওয়ার পালা। দিনভর চলে মুড়ি খাওয়া। এই মুড়ি মেলাকে কেন্দ্র করেই বিগত কয়েক দশক ধরে বসে বিশাল মেলা। বিশালকায় তিনটি কড়াইয়ে চলে প্রসাদ তৈরীর কাজ। দুপুরে মেলায় উপস্থিত মানুষদের জন্য থাকে খিচুড়ি প্রসাদ। মুড়ি ও প্রসাদ খেয়ে মেলা দেখে বাড়ি ফেরেন সকলে।
সঞ্জীবনী আশ্রম, বাঁকুড়ার একটি বহু প্রাচীন আশ্রম। প্রাচীন কাল থেকে মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে এখানে হরিনাম সংকীর্তন হয়ে থাকে। চলে মাঘের প্রথম সপ্তাহ জুড়ে। জোরকদমে চলে বিক্রিবাটা। বহু ফেরিওয়ালা আসেন এই মেলাতে। তাদের কথায় – এক মাসের দু’মোঠো খাবারের ব্যবস্থা হয়েই যায় এই মেলা থেকে। বাঁকুড়া বাসীর গর্ব এই মুড়ির মেলা। সারা বছর তারা অপেক্ষা করে থাকেন এই মেলার জন্য। এই মুড়ি মেলার সাথেই জড়িয়ে আছে প্রাচীন দ্বারকেশ্বর নদের পাড়ের সঞ্জীবনী আশ্রমের ঐতিহ্য ও পুরনো বহু স্মৃতি।
চিত্র ঋণ – সন্দীপ কর্মকার
Discussion about this post