শহর কলকাতা থেকে প্রায় ১৩২ কিলোমিটার দূরে অবস্হিত বাঁকুড়া জেলা। এই বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের নাম শোনেননি তেমন কেউ আছি বলে মনে হয় না। এই নামটা শুনলেই সাধারণত মনে আসে পুরাতন স্থাপত্য, বালুচরী শাড়ি, টেরাকোটার মন্দিরের কথা। তবে এ সকল কিছু ছাড়াও বিষ্ণুপুরের ইতিহাসের সঙ্গে আরো একটি জিনিস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যা হল বিখ্যাত মোতিচুরের লাড্ডু। এমনিতেই আমরা বাঙালিরা মিষ্টির নাম শুনলেই আবেগপ্রবণ হয়ে উঠি। পছন্দের তালিকায় নানান মিষ্টি থাকলেও বিষ্ণুপুরের মোতিচুরের লাড্ডুর আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাসও।
জানা যায় প্রায় কয়েক শতক বছর আগে বিষ্ণুপুরে মল্লরাজারা একচ্ছত্র আধিপত্য গড়ে তুলেছিলেন। এখনো বিষ্ণুপুরের আনাচে কানাচে তাদের স্থাপত্য, ভাস্কর্যের নমুনা চোখে পরে। মল্লরাজাদের উপাস্য দেবতা ছিলেন রাধাগোবিন্দ। উপাস্য দেবতার আরাধনায় কোনো ত্রুটি তারা রাখতেন না বরং চেষ্টা করতেন বেশি কিছু করে দেবতাকে সন্তুষ্ট রাখার। সেই মতো একবার এক মল্লরাজ তার রাজ মোদককে বলেন আরাধ্য দেবতার জন্য নতুন মিষ্টান্ন ভোগ তৈরি করতে। যেমন কথা তেমন কাজ। আদেশ অনুসারে রাজমোদক তৈরি করে ফেললেন নতুন মিষ্টি ভোগ। পিয়াল গাছের বীজ থেকে বেসন তৈরি করে তা দিয়েই বানালেন মোতিচুরের লাড্ডু। গাওয়া ঘি মিশিয়ে গোল্লা পাকানোর পরে তা রীতিমতো চকচক করতো দেখে একে মোতি (মুক্তো) চুর (মিষ্টি) নাম দেওয়া হয়। পরবর্তী সময় তা আর শুধু রাধাগোবিন্দর ভোগ হিসাবেই বরাদ্দ থাকেনি। এর স্বাদ আর গন্ধে তা সাধারনের কাছেও হয়ে উঠেছিল জনপ্রিয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রায় সব পিয়াল গাছই শেষ হয়ে যায়। যুদ্ধে এয়ারড্রোম প্রস্তুত করার জন্য গামারবনি, বেনাচাপড়া এলাকার সমস্ত জঙ্গল পিয়ালগাছ সমেত ধংস হয়ে যায়। ফলস্বরূপ পিয়াল বীজের বেসন দ্বারা মোতিচুরের লাড্ডু বানানো বন্ধ হয়ে পরে। কিন্তু তাই বলে তা সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়নি। এরপরে পিয়ালবীজের বেসনের পরিবর্তে সহজলভ্য বেসন দ্বারাই তা আবার তৈরি হতে থাকে। বিষ্ণুপুর এলাকার প্রতিটি দোকানেই পাওয়া যাবে এই মোতিচুরের লাড্ডু। বর্তমানে কলকাতার রসগোল্লা বা বর্ধমানের সীতাভোগ মিহিদানার পর এবার জিআই স্বীকৃতি আদায়ে তৎপর বিষ্নুপুরবাসী। ইতিমধ্যে মিষ্টি ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠক করে ফেলেছেন মহকুমা শাসক। সেই বৈঠকে যোগ দিয়েছেন খড়্গপুর আইআইটির অধ্যাপক সহ একটি প্রতিনিধি দল। আশা করা যায় বিষ্নুপুরের মোতিচুর লাড্ডু জিআই স্বীকৃতি পেলে এর চর্চা এবং বিক্রি দুই-ই পরিমাণে বাড়বে।
Discussion about this post