কলকাতার ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির কাছে ১৩৪ নম্বর মুক্তারামবাবু স্ট্রীট। রাস্তার কাছাকাছি একটি মেসবাড়ি। নাম ‘ক্ষেত্র কুঠি মেসবাড়ি’! বলা ভাল, পুরনো পলেস্তারা খসে পড়া ঘর। ঘরের কঙ্কাল বেরিয়ে পড়েছে। চাঙড় ঝরে পড়া সেই ঘরের ভিতরেই রয়েছে বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের স্পর্শ। তাঁর ব্যবহৃত সামগ্রী। আলমারি ভর্তি অসংখ্য বইপত্র। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি এই মেসের ঘরেই কাটিয়েছিলেন। মৃত্যুর পাঁচ মিনিট আগেও বলে উঠেছিলেন, “ফারস্ট ক্লাস আছি!” সেই ঘর আজ ব্যবহারের যোগ্যও প্রায় নেই। কখন মাথার উপর কড়ি বরগা খুলে পড়বে তারও নেই ঠিক।
কথা হচ্ছে বাংলার অন্যতম রসসাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তীকে নিয়ে। তিনি নিজে অবশ্য নিজের নাম ‘শিব্রাম চক্কোত্তি’ লিখতেই পছন্দ করতেন। শিব্রাম চক্কোত্তি আজীবন অকৃতদার থেকেছেন। এবং জীবনের শেষদিনটি পর্যন্ত বাস করেছেন মুক্তারামবাবু স্ট্রীটের এই মেসবাড়িতে। এখানেই ‘মুক্তারামে থেকে, তক্তারামে শুয়ে, শুক্তারাম খেয়ে’ শিবরাম তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুকের বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছেন, তা বিশ্বাস করতেও অবাক লাগবে। কারণ, বাড়িটি আজ রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কারের অভাবে প্রায় ভেঙে পড়তে বসেছে। মেসবাড়িতে বিগত বছরেও কিছু আবাসিক থাকলেও, বর্তমানে তালা পড়েছে দরজায়।
শিবরাম চক্রবর্তীর ঘরের দেওয়ালে নাকি ছিল প্রচুর আঁকিবুঁকি। ভাল করে দেখলে বোঝা যেত সেইসব আঁকিবুঁকি আসলে বিভিন্ন লোকের নাম ও ঠিকানা। সেসব দেখেই নাকি শিবরাম বুঝতেন কার কাছে কত দেনা বাকি। রসিক সাহিত্যিকের জীবনেও যেন রসিকতার অভাব ছিল না। রাজ পরিবারের সন্তান হওয়ার পরেও শিবরাম আরাম খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর মেস বাড়ির ঘরটিতে। সেই ঘরটিই যেন শিবরামের জীবনের একটি অঙ্গ। অথচ, কলকাতার আর পাঁচটা পুরনো বাড়ির মতই ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হল এই বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাড়িটিকে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রায় শেষের দিক। তখনই শুরু হয়েছিল শহরের এই মেসবাড়ি কালচার। শিক্ষিত বাঙালিরা কাজের খোঁজে বিভিন্ন জেলা থেকে আসতেন কলকাতায়। এসেই শুরু হত মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের খোঁজ। সেই কারণেই সম্ভবত তৈরি হয়েছিল অসংখ্য মেসবাড়ি। বাংলা সাহিত্যেও এর প্রভাব দেখা যায়। ব্যোমকেশ থেকে ঘনাদা সকলেই মেসবাড়ির বাসিন্দাই ছিলেন। সেই মেসবাড়ির সংস্কৃতি আজ ‘পেইং গেস্ট’ বা ‘পিজি’ তে বদলে গেছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের আন্তরিকতার প্রকাশের সেই সময়ও আর নেই। ফলে, শিব্রাম চক্কোত্তির আরামের ঘরের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি নিয়েও আধুনিক ব্যস্ত সমাজের মাথা ব্যথার অবকাশ নেই।
Discussion about this post