গানের কথায় ‘মেদিনীপুরের আয়না চিরন’। শুধুই আয়না বা চিরুনি নয়। আছে জি আই ট্যাগ পাওয়া কুটির শিল্পও। এসেছে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার। শিল্পটি হল মাদুর শিল্প। কাঠির বুনন যেমন টেনেছে বৈঠকী আড্ডার আসর। উঠে এসেছে সীতা হরনের পালা। শিল্পের অদ্ভুত বুনোটে খ্যাতি এসেছে মেদিনীপুরে। সবং, রামনগর, এগরা, উদয়নারায়ণপুরের অধিকাংশ মানুষই মাদুর শিল্পকে রুজির পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। মাদুর শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘মন্দুরা’ থেকে। এর আগমন বহু প্রাচীন। আনুমানিক সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকেই ব্যবহার করা হতো এটি। অথর্ব বেদ রেখেছে মাদুরের উল্লেখ। মহাভারতে উল্লিখিত শুকনো ঘাসের আসন বাড়িয়েছে মাদুরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব। মাদুর ছিল মুঘল আমলেও। জনৈকা বেগম মুঘল সম্রাটকে উপহার দেন মসৃণ মাদুর। তারপর ঐ মসৃণ মাদুরের ব্যবহার সর্বজনবিদিত হয়ে ওঠে। মছলন্দ নামে পরিচিত হয় তা।
মাদুর যে উদ্ভিদ থেকে পাওয়া যায় তার বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘সাইপ্রাস প্যানগোরি’। এই বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ জন্মায় নদীর পাড়ে প্রাকৃতিকভাবে।ক্রমে প্রয়োজনের তাগিদ এসেছে মাদুর কাঠির। তাই এখন গোটা মেদিনীপুর জুড়েই চাষ হচ্ছে তা। নবীন পলি সমৃদ্ধ স্থানে চাষ হয় মাদুরের। গ্রীষ্ম ও বর্ষার আর্দ্র আবহাওয়ায় চাষ হয় এই কাঠি। ক্ষেত থেকে মাঘ মাসে তোলা হয় মূল। রেখে দেওয়া হয় ছায়ায়।চার পাঁচদিন পর দেখা দেয় অঙ্কুর। চৈত্রের মাঝামাঝি শুরু হয় ফলন। আশ্বিন ও কার্তিকে মাদুর কাঠি ফলে। তারপর কাঠি গোড়া থেকে কেটে ফেলা হয়। এতে ব্যবহার করা হয় গেঁজে ছুরি।
বাংলায় মাদুর তিন প্রকার। একহারা, দোহারা আর মসলন্দ। একহারা মাদুর বুনতে লাগে মাদুর কাঠি, সুতলি, বাঁশের খুঁটি ও শাল কাঠের শানা। দোহারা মাদুরের জন্য প্রয়োজন এ সবই কিন্তু শানার জন্য প্রতি ৯ ইঞ্চিতে ৯ থেকে ১০টা। মসলন্দ মাদুরের জন্য আরও প্রয়োজন গোল বাঁশের চটা। শানায়ও তারতম্য হয় প্রতি ৯ ইঞ্চিতে ২৮ থেকে ৪৮। মসলন্দ মাদুরের কাঠি থেকে মাঝখানের সাদা অংশটি ছেঁটে বাদ দিতে হয়। এরপর আসে রঙের পালা। রঙ ও শৈল্পিক কারুকাজের পর মাদুর বিক্রি করা হয় হাটে ও ডিলারদের কাছে। সবংয়ে ছ’শো কোটির মাদুর ব্যবসা হয়। এখন এসেছে হাব। মেদিনীপুরের মাদুর শিল্পীরা বুনছেন প্রচুর মাদুর। ওজন অনুযায়ী দাম পান ওনারা। এহেন যান্ত্রিক যুগেও জিয়া নস্টাল মাদুর টিকে আছে শিল্প হিসেবে। রুজি আনছে বহু মানুষের। এটাই অনেক।
Discussion about this post