‘মধুবনী’ ভারতের বিহার রাজ্যের মধুবনী জেলার একটি শহর ও পৌরসভা এলাকা। ভারতীয় চিত্রকলার ইতিহাসে অন্যতম প্রাচীন চিত্রকলা হল মধুবনী চিত্রকলা। বর্তমান নেপাল ও বিহারের উত্তর সীমান্ত জুড়ে অবস্থিত ছিল মহাকাব্যের রাজা জনকের মিথিলা রাজ্য। প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে মিথিলার গ্রাম মধুবনে এক বিশেষ ধরনের চিত্রকলা গড়ে উঠেছিল। সেই গ্রামের নাম অনুসারে এই চিত্রকলাটির নাম দেওয়া হয় ‘মধুবনী চিত্রকলা’। কথিত আছে – মহারাজা জনক তাঁর প্রিয়তমা কন্যা সীতার বিয়ের আগে, রাজ্যবাসীদের আদেশ দিয়েছিলেন, রাম -সীতার বিয়ে উপলক্ষে গোটা রাজ্যকে রঙিন চিত্রে সুসজ্জিত করে দেওয়ার জন্য। রাজ্যবাসী খুশি মনে সারা রাজ্যকে রাম-সীতার বিবাহ সম্পর্কিত বিভিন্ন চিত্র এঁকে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে মধুবনী চিত্রকলার জন্ম। মিথিলাতে সৃষ্টি হওয়ার কারণে এই চিত্রকলাকে ‘মিথিলা চিত্রকলা’ও বলা হয়।
১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের আগে মধুবনী চিত্রকলা বাইরের জগতের সাথে অপরিচিত ছিল।১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ভারত- নেপাল সীমান্তে একটি ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের ফলে এই অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেই সময় মধুবন জেলার ব্রিটিশ কলোনিয়ান অফিসার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন উইলিয়াম আর্চার। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত জেলাটি দেখতে এসে মধুবনী চিত্রকলার খোঁজ পেয়েছিলেন এবং এই দেয়াল চিত্রগুলি দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, আর সেগুলোর অনেক ছবি তুলেছিলেন।
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মধুবনী চিত্রকলা সম্বন্ধে মার্গ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লেখেন এবং সেটি জনসাধারণের সামনে তুলে ধরেছিলেন। সেই সময় ভারতীয় হ্যান্ডিক্রাফ্ট বোর্ডের অধিকর্তা পুপুল জয়কার মুম্বাইয়ের একজন শিল্পী শ্রী ভাস্কর কুলকার্নিকে মিথিলায় পাঠিয়েছিলেন,যাতে মধুবনের মহিলারা দেয়ালে যে ছবি আঁকতেন তা কাগজে এঁকে বিক্রি করতে পারে। এইভাবে পুপুল জয়কারের উপস্থাপনায় মধুবনে মধুবনী চিত্রকলার এক নতুন সূচনা হয়। মধুবনী চিত্রগুলি নতুনভাবে প্লাস্টার করা মাটির দেয়াল এবং ঝুপড়িগুলির মেঝেতে করা হয়েছিল। যদিও এখন এই চিত্রগুলি কাপড়, হাতে তৈরি কাগজ এবং ক্যানভাসেও করা হয়।
মধুবনী চিত্রগুলিতে বেশিরভাগ প্রাচীন গল্প থেকে প্রকৃতির দৃশ্য এবং দেবদেবীদের সাথে তাদের সংযুক্তির চিত্র আঁকা হয় যেমন- রাম-সীতা,রাধা-কৃষ্ণ,চন্দ্র,সূর্য,বাঁশগাছ,মাছ, পাখি প্রভৃতি মোটিফ এক হয়। মধুবনী চিত্রকলা সম্পূর্ণরূপে গ্রামীন ও লোকশিল্প। তাঁরা মধুবনী চিত্রকলার জন্য বিভিন্ন ধরনের জিনিস থেকে রং তৈরি করত যেমন নীল গাছ থেকে নীল রং, চালের গুঁড়ো থেকে সাদা রং, ভুষো কালি থেকে কালো রং, শিমপাতা থেকে সবুজ রং, হলুদ থেকে হলুদ রং তৈরি করা হত।
সাধারণতঃ এই চিত্রকলা পাঁচটি ধরন দেখতে পাওয়া যায়- ভরনি,কাচনি,তান্ত্রিক,নেপালি, গোবর।মধুবনী চিত্রকলার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল ডবল কন্ট্যুর রেখা। এই ডবল কন্ট্যুর রেখা মধুবনী চিত্রকলা ছাড়া আর অন্য কোনো চিত্রকলায় দেখা যায় না। এই চিত্রকলায় খালি জায়গাগুলি ফুল,প্রাণী,পাখি এমনকি জ্যামিতিক ডিজাইনের চিত্র দিয়ে ভরাট করা হয়। জ্যামিতিক আকারে সমৃদ্ধ মধুবনী চিত্রকলা সম্পূর্ণরূপে আদিবাসী লোকশিল্পরূপে ধরা হয়। দেওয়াল চিত্রগুলিকে “ভিত্তি চিত্র” বলা হত। যে সমস্ত মধুবনী চিত্র মেঝেতে আঁকা হত তাদের ‘আরিপানা’ বলা হত।
মধুবনী চিত্রকলা পাঁচ প্রকারের হয় -ভরনি, কাচনি, তান্ত্রিক, গোদনা, কোহবার। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ভরনি, কাচনি ও তান্ত্রিক এই তিন প্রকারের মধুবনী চিত্র শুধুমাত্র সমাজের উচ্চবর্গীয় ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ মহিলারাই আঁকতে পারতেন। তাঁরা মূলত পৌরাণিক কাহিনী ও দেবদেবীর চিত্র আঁকতেন। নিম্নবর্গীয় মহিলারা গোদনা ও কোহবার প্রকারের মধুবনী চিত্র আঁকতেন যা প্রধানত সেকালের সামাজিক জীবন ও মধুবন গ্রামের রক্ষাকর্তা রাজা শৈলেশের কীর্তিকাহিনী বর্ণনা করত। বর্তমানে মধুবনী চিত্রকলার সারা বিশ্বে বিখ্যাত হওয়ার দরুন জাতিভেদ প্রথা লোপ পেয়ে সবাই মিলেমিশে সব ধরনের চিত্র আঁকেন।
Discussion about this post