একটা সময়ে পূর্ব ভারতের বিস্কুট শিল্পে একটা প্রভাবশালী নাম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল কোলে বিস্কুট। তবে, আজ কিছুটা নিজেদের ভুলেই বিস্কুটের দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই সংস্থা। এই কোম্পানির উত্থান ও পতনের গল্পটা একটা সমৃদ্ধ ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। ১৯৪৮ সালে বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা এবং বাঁকুড়ার জমিদার পরিবারের সদস্য জগন্নাথ কোলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই কোলে বিস্কুট কোম্পানি। অল্প সময়ের মধ্যেই এই কোম্পানিটি তার গ্লুকোজ বিস্কুট এবং অন্যান্য বেকারি পণ্যের জন্য সারা বাংলায় পরিচিত হয়ে ওঠে। পার্লে-জির মতো স্বদেশী ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে একটা সময়ে কড়া টক্কর দিত এই কোলে বিস্কুট কোম্পানি।
এই কোম্পানির সাফল্যের মূলে ছিল তাদের উৎকৃষ্ট মানের পণ্য। বঙ্গভঙ্গ পরবর্তী সময়ে, ঊনবিংশ শতকে বাংলায় যেভাবে বিদেশি পণ্য বর্জনের ধারা শুরু হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় জনপ্রিয়তা পায় কোলে বিস্কুট কোম্পানিটি। এর গ্লুকোজ বিস্কুট শুধুমাত্র ভারতের বাজারে নয়, একটা সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও খ্যাতি অর্জন করেছিল। স্বল্প সময়ের মধ্যেই এই ব্র্যান্ডের প্রসার এতটাই বৃদ্ধি পায় যে, সেই সময় তাদের ল্যাক্টো বনবন লজেন্স সেই সময়ের শীর্ষস্থানীয় পণ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
এই কোম্পানির বিজ্ঞাপনেও ছিল নানারকম চমক। ১৯৭০ এর দশকে উত্তম কুমারের বিজ্ঞাপনগুলি কোলে বিস্কুটকে একটা নতুন মাত্রা দিয়েছিল। বাংলা চলচ্চিত্র সুপারস্টারের হাসি মুখ এবং আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনী কৌশল এই কোম্পানির জনপ্রিয়তা অনেকটাই বাড়িয়ে তোলে। পাশাপাশি, এই কোম্পানির পণ্যগুলো নান্দনিক এবং ব্যবহারিক উভয়দিক থেকেই গ্রাহকদের আকৃষ্ট করেছিল। এই টিনের বাক্সগুলি আজও ভিন্টেজ সংগ্রাহকদের জন্য বেশ মূল্যবান।
তবে এই কোম্পানির জনপ্রিয়তা খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৮০-র দশকের দিকে কোম্পানিটি নানা অভ্যন্তরীণ এবং বহিরাগত সমস্যায় জর্জরিত হতে শুরু করে। পারিবারিক দ্বন্দ্ব এবং সম্পত্তির বিভাজন এই কোম্পানির ভিত নড়িয়ে দেয়। সঙ্গেই, এই কোম্পানিটি সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে এবং আধুনিকায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করতে ব্যর্থ হয়। ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকাটা আর সম্ভব হয়নি কোলে বিস্কুটের জন্য। অবশেষে আশির দশকের শেষের দিকে এই কোম্পানি লিকুইডেশনের সম্মুখীন হয়।
পশ্চিমবঙ্গের শিল্প ইতিহাসে কোলে বিস্কুট একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে থেকেই যাবে। তাদের তৈরি করা পণ্যগুলির প্রতি গ্রাহকদের যে নস্টালজিয়া, তা আজও ভিন্টেজ মার্কেটিং সাইটে লিস্ট করা পুরনো টিনের বাক্সের মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায়। এই কোম্পানিটি এখন আর নেই, তবে তার স্মৃতিগুলো বাঙালি পরিবারের চা-আড্ডা আর টিফিনবাক্সের গল্পের সঙ্গে চিরকাল জড়িয়ে থাকবে।
Discussion about this post