শিল্পের প্রতি ভালোবাসা, সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং সৃষ্টিশীলতার এক অনন্য উদযাপন নিয়ে খামখেয়াল আয়োজন করছে এক বিশেষ প্রদর্শনী। ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫-এ, কলকাতার খামখেয়াল বাড়ি পরিণত হবে পুতুলশিল্প ও লোকজ কারুশিল্পের এক প্রাণবন্ত আসরে। এই আয়োজন শুধুমাত্র একটি প্রদর্শনী নয়, বরং এটি এক উৎসব—যেখানে শহরের গণ্ডির বাইরে থাকা দক্ষ শিল্পীরা তাঁদের সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে মিশে যাবেন। তাঁদের হাতের নিপুণ কারুকাজ, লোকশিল্পের শিকড় ছোঁয়া সৌন্দর্য, আর শিল্পী ও দর্শকের আন্তরিক সংযোগ—সব মিলিয়ে এই দুই দিন হবে ভালোবাসার খামখেয়াল।
![](https://dailynewsreel.in/wp-content/uploads/2025/02/IMG-20250213-WA0007-ezgif.com-resize-1024x576.jpg)
এই শিল্প প্রদর্শনীর বিষয়ে আরো জানতে খামখেয়াল টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করে ডেইলি নিউজ রিল। খামখেয়ালের সুঞ্জনা দত্ত রায়ের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘ কথোপকথন হয় এই শিল্প প্রদর্শনী নিয়ে। খামখেয়ালের শিল্পচর্চা কি নিছকই এক খেয়াল? নাকি তার পেছনে থাকে এক দীর্ঘ পরিকল্পনা, এক সুগভীর চিন্তাভাবনা? খামখেয়ালের জন্ম কীভাবে?—এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, খামখেয়ালের জন্ম কোনোভাবেই খামখেয়ালিপনায় হয়নি। বরং এর ভিত রচিত হয়েছে এক সুপরিকল্পিত দর্শনের ওপর। খামখেয়াল শব্দটির মধ্যেই রয়েছে তার মূলমন্ত্র—”খাম ভর্তি খেয়াল উড়িয়ে দেওয়া।” আমরা প্রত্যেকেই একসময় কিছু না কিছু শিল্পচর্চার স্বপ্ন দেখি, কিছু সৃষ্টিশীলতার আনন্দে ডুব দিতে চাই। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবতার ভারে হারিয়ে যায় সেই ইচ্ছা, চাপা পড়ে যায় জীবনের যাঁতাকলে। বিশেষ করে আমাদের দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে স্বতন্ত্রভাবে শিল্পচর্চা করে যাওয়া এক দুরূহ কাজ। আমাদের খামখেয়াল সেই সমস্ত শিল্পীদের জন্য, যারা নিজের শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে কাজ করে চলেছেন। এখানে প্রতিযোগিতা থাকলেও রেষারেষি নেই, বরং রয়েছে এক সৌহার্দ্যময় পরিবেশ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আর শিল্পের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা।
এই ভালোবাসার পরিসর কি সকলের জন্য এক? খামখেয়ালে কারা বেশি অগ্রাধিকার পান?—এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, খামখেয়াল মনে করে, শিল্প তখনই প্রাণ পায়, যখন তা শিল্পীর নিজস্ব সত্তার প্রকাশ ঘটায়। সে কারণেই, এখানে তাঁদেরই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, যাঁরা নিজের হাতে কিছু সৃষ্টি করে চলেছেন, নিজস্ব ব্র্যান্ডের তলায় নিজের কাজকে গড়ে তুলেছেন। যাঁরা শুধু অন্যের তৈরি জিনিস এনে বিক্রি করেন, তাঁদের প্রতি কোনো বিরূপতা নেই, কিন্তু খামখেয়াল চায় সেই শিল্পীদের পাশে দাঁড়াতে, যাঁরা সত্যিকার অর্থেই নিজের মনের কথা শিল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চান। এই প্ল্যাটফর্ম বিশেষভাবে তাঁদের পাশে দাঁড়ায়, যাঁরা নতুনভাবে শিল্পচর্চা শুরু করেছেন, যাঁরা এখনো নিজের জায়গা তৈরির লড়াইয়ে আছেন। খামখেয়ালের সাম্প্রতিক প্রদর্শনীতে প্রায় ২০ জন নবীন শিল্পী জায়গা পেয়েছেন, যা এই দর্শনেরই প্রতিফলন।
প্রতি বছরের মতো, এবারও বছর শুরুর খামখেয়াল আয়োজন করছে এক বিশেষ প্রদর্শনী। এবারের পরিকল্পনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলার লোকশিল্প, তার সংস্কৃতি, তার অতীতের ঐতিহ্যই এবারের মূল ভাবনা। বাংলার শিল্প-সংস্কৃতি আমাদের গৌরব, আমাদের আত্মপরিচয়। একে বাঁচিয়ে রাখা, একে নতুন করে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা আমাদেরই দায়িত্ব। তাই এবার বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের ছ’জন প্রবীণ শিল্পী, যাঁরা বহু বছর ধরে বাংলার লোকশিল্প চর্চা করে আসছেন, থাকছেন এই প্রদর্শনীতে বিশেষ মুখ হিসেবে।
খামখেয়ালের আরেকটি বড় দৃষ্টিভঙ্গি হলো, শিল্পের স্থানকেও নতুনভাবে চিনে নেওয়া। সাধারণত অনেক প্রদর্শনীই হয় ঝাঁ-চকচকে গ্যালারিতে, শহরের অভিজাত অঞ্চলে। কিন্তু খামখেয়াল মনে করে, শিল্প শুধু দক্ষিণ কলকাতার নির্দিষ্ট কয়েকটি গ্যালারির জন্য নয়, শিল্পের প্রাণ রয়েছে প্রতিটি অলিগলিতে, প্রতিটি শিল্পীর ঘরে। তাই খামখেয়ালের প্রদর্শনী হয় উত্তর কলকাতার পুরনো বাড়িতে, শান্তিনিকেতনের অচেনা কোনো কোণে, কিংবা মধ্য কলকাতার কাগজপট্টির এক চিলতে ছাদেও। শিল্পের সাধক যিনি, তাঁর আশপাশের মানুষদেরও তাঁর কাজ জানা দরকার। তাঁদেরও বোঝা দরকার, কীভাবে এক শিল্পী তার সৃষ্টির মধ্যে নিজের আত্মার ছাপ রেখে যান।
২০২৫-এর খামখেয়াল তাই শুধুই এক প্রদর্শনী নয়, এটি এক অঙ্গীকার। এটি এক চলমান প্রয়াস, যেখানে নতুন পুরনো হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যায়, যেখানে শিল্পের সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে যায় ভালোবাসা। আমরা অপেক্ষায় থাকব আপনাদের জন্য, আসুন এবং হয়ে উঠুন এই শিল্পোৎসবের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ!
Discussion about this post