কলকাতা শহরটার আবেগ বরাবরই বেশী। সেটা রাজনীতি, খেলাধুলো বা উৎসব সবকিছুতেই লক্ষণীয়। পুজোকে ঘিরে মহানগরীর মানুষজনের নান্দনিকতা, বিশ্বচেতনা, সামাজিক পারিপার্শ্বিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে। দুর্গাপুজো এখন একটা উৎসব নয়, একটা উপার্জনেরও উৎস। ১৭৬৬ সালের হলওয়েলের ইন্টারেস্টিং হিস্টোরিক্যাল ইভেন্টস্ বইতে জানা যায় রাজা নবকৃষ্ণই প্রথম ইংরেজ সাহেবদের তাঁর আয়োজিত পুজোয় আহ্বান করেন। পুরনো কলকাতায় পুজো বাড়িতে বিশেষ আমোদ প্রমোদ, ভুরি ভোজের উল্লেখ পাওয়া যায় ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দের ফ্যানী পার্কসের ভ্রমণ বৃত্তান্ত বইতে। প্রথমে দেবী ছিলেন দ্বিভূজা আর দন্ডায়মান। পরে দেবী চর্তুভূজা, অষ্টভূজা এবং শেষে দশ ভূজা রূপে পূজিতা হন। আসলে সময়ের সঙ্গে সব কিছুই বদলায়। সময়ের সঙ্গে থিম পুজোর বাড় বাড়ন্ত ঘটেছে। বহু পুজো উদযাপনের পিছনেও রয়েছে নানা ইতিহাস।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় কাশী বোস লেনের পুজোর কথা। হাতিবাগানের গা ঘেঁষে বিধান সরণী দিয়ে আরেকটু দক্ষিণ দিকে এলেই স্কটিশচার্চ স্কুলের প্রায় উল্টো দিকে কাশী বোস লেন। এখানে পুরনো সুতানটির স্পর্শ পাওয়া যায়। দেবী পুজোর মাহাত্ম্যকেই ভক্তি সহকারে আরাধনা এই পুজোর মূল লক্ষ্য। তাই গ্রাম বাংলার লোক, কুটির শিল্প কেন্দ্রিক মন্ডপ আর প্রতিমাই এখানে বেশী গ্রহণীয়। শোনা যায় এই পুজোর সূত্রপাত ১৯৩৪ থেকে ৩৫ সালের মধ্যে। কাশী বোস লেনে ক্যাপিটাল ক্লাবের নামে এ.সি রায় ও সিমলা ব্যায়াম সমিতির কর্তাব্যক্তিদের পরোক্ষ উদ্যোগে দুর্গাপুজো শুরু হয়। ১৯৩৫ সালে সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজো আবার শুরু হলে পাড়ার কিছু তরুণের উদ্যোগে আবার পুজো চলতে থাকে। এখানকার প্রতিমা বিশাল যার মধ্যে মাতৃভাব বিরাজমান। সাবেকি এক চালার ঠাকুর। এই পুজোর ফুল আসত ঝাঁঝা থেকে। বি কে পালের বাগান থেকে আসত গোলাপ, পদ্ম আর মরশুমি ফুল। এখানে প্রথমা থেকে পঞ্চমী পর্যন্ত চন্ডীপাঠ হয়। নবমীর দিন দেবীকে বাহান্ন ভোগ দেওয়া হয়। দীর্ঘ সতেরো বছর ধরে দশজন পুরোহিত এই পুজো নিষ্ঠার সঙ্গে করে থাকেন। পরবর্তীকালে শিল্পীর সঙ্গে আলোচনা করেই এই পুজোর রূপদান করা হয়। কোন প্রতিযোগিতা এখানে প্রাধান্য পায় না।
আবারও যদি পুরনো কলকাতায় ফিরে যাওয়া যায়, সেখানে এত পাড়াকে ঘিরে পুজোর আয়োজন হতে দেখা যায় নি। বারোয়ারী পুজোর আগে বিভিন্ন বিত্তশালী মানুষজনের বাড়িতেই দুর্গাপুজোর আয়োজন হত। তার মধ্যে প্রাণকৃষ্ণ সিংহ, কেষ্টচাঁদ মিত্র, নারায়ণ মিত্র, রামহরি ঠাকুর, দর্প নারায়ণ ঠাকুর, রাজা সুখময় রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এই বিত্তশালী মানুষজনদের বাড়িতে পুজোকে ঘিরে বাঈজী গান নাচের আসর বসত। এখন যদিও সবই অতীত। সময় ধীরে ধীরে এমনভাবে পাল্টেছে যেখানে দুর্গা পুজো কলকাতার বঙ্গজীবনের মুখ হিসাবে সারা পৃথিবীর কাছে উঠোনে হাজির হয়।
চিত্র ঋণ – https://www.kashiboselane.com/, শতদ্রু কর
Discussion about this post