সালটা ১৯০৮। ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলন তখন চরম পর্যায়ে। দিকে দিকে বিপ্লবীদের স্লোগান এবং সংগ্রাম। নিজের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার লড়াইয়ে প্রাণটুকুও বাজি রাখছেন তাঁরা। এরকম শত বিপ্লবীর মধ্যেই একজন ছিলেন সেই ছাপোষা এক বাঙালী। ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই তখন তুঙ্গে। স্বাধীনতা সংগ্রামী আন্দোলনের দায়ে বন্দী হলেন তিনি। কারাগারের মধ্যেই অভিযোগ উঠল নিজেরই সহকর্মীকে খুনের। আদালতে বিচার হল। শাস্তি কঠিনতম অর্থাৎ ফাঁসি। শুনেও তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। ফাঁসির দিন আসা পর্যন্ত সাজা হল কারাবাস। কারাগারের মধ্যে থেকেও সর্বক্ষণ মুখে স্বভাবসিদ্ধ হাসিটি লেগেই থাকত। ফাঁসির আগেরদিনও হাসি মুখ দেখে জেলের ওয়ার্ডার তাঁকে কিছুটা বিদ্রুপই করলেন। কিন্তু সেসবের তোয়াক্কা তিনি থোড়াই করেন! ফাঁসির দিন সকালেও ওয়ার্ডার দেখলেন মুখে সেই হাসি। আর ঠিক সেভাবেই হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পড়েছিলেন তিনি। কালো কাপড়ে মুখ না ঢেকেই। তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম এক বাঙালী বিপ্লবী, কানাইলাল দত্ত।
জন্ম চন্দননগরের দত্ত পরিবারে। ১৮৮৮’র জন্মাষ্টমীতে আজকের দিনেই। মা-বাবা তাই নাম রাখলেন কানাই। পড়াশোনা হুগলী কলেজ থেকে (বর্তমানে হুগলি মহসিন কলেজ)। তাঁর অধ্যাপক ছিলেন জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ। এরপর আলাপ চারুচন্দ্র রায়ের সঙ্গে। ব্যাস! তারপরই স্বাধীনতা আন্দোলনে নিজেকে নিযুক্ত করতে কলকাতায় এলেন তিনি। শুরু হল লড়াই। ১৯০৮ সালে কিংসফোর্ড হত্যা এবং মানিকতলা বোমা মামলায় বন্দী হলেন কানাইলাল। সঙ্গে অরবিন্দ ঘোষ, সত্যেন্দ্রনাথ বোস সহ আরও বহু বিপ্লবী। মামলায় রাজসাক্ষী হিসাবে দাঁড়ালেন তাদেরই সহকর্মী নরেন গোঁসাই। কিন্তু সাক্ষী হিসাবে তিনি যদি সব বলে ফেলেন তাহলে তো বিপ্লবীদেরই বিপদ। তাই তাঁকে হত্যা করার দায়িত্ব দেওয়া হল কানাইলাল রায় এবং সত্যেন বোসকে। ৩১ অগাস্ট জেল হাসপাতালের মধ্যে পুলিশের চোখের সামনেই তাঁরা হত্যা করলেন সেই বিশ্বাসঘাতককে। এরপর সেই হত্যার মামলা উঠল আদালতে। মৃত্যুদণ্ডের হুকুম দেওয়া হল দুই বিপ্লবীকে।
এরপর এল সেই দিন। ওয়ার্ডার এথান প্রাইস বরাবরই ভালো নজরে দেখতেন না কানাইলালকে৷ ফাঁসির হুকুম হওয়ার পরও মুখে এত হাসি থাকে কি করে! আস্তে আস্তে ফাঁসির মঞ্চে উঠলেন কানাই। সেই হাসি মুখেই৷ হঠাৎই ওয়ার্ডারের কানে এল ছোট্ট একটি অনুরোধ। কালো কাপড়ে যেন মুখ না ঢাকা হয় বিপ্লবীর। তিনি মুখ না ঢেকেই হাসি মুখে ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে চান। সেই ইচ্ছাই রাখা হল। গলায় দড়ি লাগানোর পরও সেটি মনোমত হল না তাঁর। নিজের হাতে নিজেরই ফাঁসির দড়ি ঠিক করে দিলেন তিনি। তারপর, পাটাতন সরল। ফাঁসিতে ঝুললেন কানাইলাল।
তাঁর মৃত্যুর পর জেলের বাইরে এক প্রকার ভিড়ই জমে গিয়েছিল। কানাইয়ের শবযাত্রা কাঁধে তুলে নিয়ে ‘জয় কানাই’ ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠেছিল চারপাশ। এর আগে কোনও বিপ্লবীর শেষযাত্রায় এত ভীড় কখনও হয়নি৷ অবাক হয়ে গেছিলেন ইংরেজ পুলিশের দলও৷ এমনকি কেওড়াতলা শ্মশানে কানাইলালের দেহ পোড়ানোর পর নিলামেও নাকি ওঠে তাঁর চিতাভস্ম। সেই সময় বহু অর্থের বিনিময়েও সেই ভস্ম কিনতে রাজি হয়েছিলেন কেউ কেউ। আপামর কলকাতা তথা ভারতবাসীর ঠিক এতটাই কাছের ছিলেন কানাইলাল। মৃত্যুর পরও এভাবেই তিনি রয়ে গেছিলেন মানুষের হৃদয়ে।
Discussion about this post