এক খিলি পান, যার দামই নাকি ১০০০ টাকা! কি বিশ্বাস হচ্ছে না তো! খোদ কল্লোলিনী কলকাতার বুকেই অবস্থিত বিখ্যাত এই পানের দোকান। নাম কল্পতরু পান সেন্টার। ইন্দিরা গাঁধী থেকে রাধাকৃষ্ণন, উত্তমকুমার থেকে মান্না দে, বহু গুণীজন এই দোকানের পান খেয়েছেন। আর এই দোকানেরই ১০০০ টাকার, আরও নির্দিষ্ট করে বললে ১০০১ টাকার পানের চাহিদা আজও অটুট। ৫ টাকা দামের ‘মুখরঞ্জন’ই হোক বা ১০১ টাকা দামের ‘বেনারস রুচি’। এই দোকানে রয়েছে নানা ধরনের পানের সম্ভার। তবে, সবচেয়ে বিখ্যাত হল ১০০১ টাকা দামের পান ‘কল্পতরু স্পেশ্যাল’। কিন্তু এত দাম কেন এই পানের? বংশ পরম্পরায় বর্তমানে দোকানের দায়িত্বে রয়েছেন শ্যামল দত্ত। তিনিই জানালেন, এলাহাবাদ, লখনউ, চেন্নাইয়ের মতো বিভিন্ন জায়গা থেকে পান সাজার জন্য বাছাই করা সেরা উপকরণগুলি আনা হয়। তাই দিয়ে বানানো হয় এই ‘কল্পতরু স্পেশাল’। তাই কোয়ালিটির দিক থেকে কোনোরকম আপস করে না এই পান। ঠিক কী কী জিনিস থাকে ১০০১ টাকা দামের ‘কল্পতরু স্পেশাল’ পানটিতে একটু দেখে নেওয়া যাক! নেহরু পাতি, জাফরানে সংরক্ষিত সুপুরি, লং কেশর, জনকপুরী খয়ের, মুক্তাভস্ম চুন, বিশেষ মিক্সচার এবং আসল রুপোর তবক।
কল্পতরু ভান্ডারের জন্ম স্বাধীনতারও দশ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৩৭ সালে। কথিত আছে, সেই সময়ে এই দোকানের বাদশাহী পান মুখে দিয়ে কেউ পাড়ায় ঢুকলে পুরো পাড়া তার গন্ধ টের পেয়ে যেত। এদের পান খেয়ে গুনগান করেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসক থেকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল সহ অনেক নামকরা ব্যক্তিত্বরাও। এ ছাড়াও দোকানে টাঙানো থাকতো বিশিষ্ট কিছু মানুষের দেওয়া কল্পতরুর পানের সার্টিফিকেট। সেই সার্টিফিকেট প্রদানকারীদের তালিকায় প্রাক্তন রাজ্যপাল পদ্মজা নাইডু থেকে শুরু করে পিসি সরকার (সিনিয়র) ,ইন্দিরা গান্ধী, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ, উত্তম কুমার, মান্না দে কে না ছিলেন! দোকানের গায়ে একটা ছবি সাঁটা থাকত, নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে পা রেখেই কল্পতরুর পান মুখে পুরছেন! এরকমই অসাধারণ কিছু বিজ্ঞাপনও ছিল দোকানটির। ‘পদর্পণ করে বদন প্রসন্ন করুন’ লেখা ছাড়াও বোর্ডে টাঙানো থাকত পানের খিলির দাম সহ বিচিত্র সব নাম। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘বাদশাহী’, ‘মন মাতোয়ারা’, ‘মুখ বিলাস’ ইত্যাদি। এরকমই অসাধারণ কিছু বিজ্ঞাপনও ছিল দোকানটির। এক সময় হেদোর পুকুর পাড়ের দুর্গা ঠাকুর দেখে বেরিয়ে, ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট হলের সামনে কল্পতরুর ভান্ডার থেকে পান খাওয়া বাঙালির ফ্যাশনে দাঁড়িয়েছিল। কল্পতরু ভাণ্ডারের পান থেকে শুধু কলকাতা নয়, ভিন রাজ্য থেকেও বিভিন্ন রসিক মানুষজন ছুটে আসতেন।
তবুও কলকাতার এই ঐতিহ্য আজ ক্ষতির মুখে দাঁড়িয়ে। আগের মত প্রতিপত্তি এখন আর নেই। বর্তমান বিক্রেতা শ্যামল দত্তের কথায়, ১০০০ টাকা দামি ‘কল্পতরু স্পেশাল’ পান বিক্রি করে লাভের চেয়ে লোকসানই হয় বেশি। প্রতিটা পানে ক্ষতি হয় প্রায় দুশো টাকার। একসঙ্গে পাঁচ-ছ’খানা বিক্রি হলে তবু কিছু খরচ ওঠে, নাহলে তেমন কোনও লাভই নাকি পাওয়া যায় না। কলকাতার মানুষজন এখন নাকি পান খাওয়া ছেড়েই দিয়েছে। এখন বাঙালির মুখ-ভরা গুটখা, তারা পানাসক্তই বেশি। পানের প্রতি আসক্তি আর নেই। তাই এককালের এই রমরমা ব্যবসাও আজ ক্ষতির মুখে। তবে এখনও দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষজন এসে এই দোকানের খোঁজ করেন। পান সাজিয়ে নিয়ে যান। এমনকি কিছুক্ষেত্রে ৫০০-১০০০ টাকার পানেরও চাহিদা থাকে তাদের মধ্যে। তাই এসবের মধ্যেই একটু করে আশার আলো দেখতে থাকে ১০০০ টাকার মহার্ঘ সেই পানের আঁতুড়ঘর ‘কল্পতরু পান ভান্ডার’।
Discussion about this post