আধুনিক শহুরে সংস্কৃতির ধাক্কায় দিন দিন আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বহু গ্রামীণ সংস্কৃতি। হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রীতিও। হারিয়ে যাওয়া এই সংস্কৃতির তালিকায় অন্যতম ভিন্ন স্বাদের ‘কাজীর ভাত’। এক সময়ে গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরেই ঘটা করে আয়োজন করা হতো ‘কাজীর ভাত’। কিন্তু এই রীতি বর্তমানে প্রায় দেখাই যায় না। কাজীর ভাত গরমকালে রান্না করা হয়। একসময়ের পূর্ববঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশের গ্রামীণ ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে মজার এই খাবারটি। বিশেষ করে ঢাকা জেলা, বিক্রমপুর, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, যশোরের গ্রামীণ জনপদে রান্না হয় কাজীর ভাত। বর্তমানে এই খাবার খুব বেশি প্রচলিত না হলেও গ্রামে বসবাসরত পরিবারগুলোতে বছরে অন্ততঃ দু’একবার কাজীর ভাত রান্না হয়। কাজীর ভাত রান্না উপলক্ষ্যে বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনদের উপস্থিতিতে এক মিলনমেলা লক্ষ্য করা যায়।
কাজীর ভাত দেখতে সাধারণ ভাতের মতো হলেও কাজীর ভাত এক বিশেষ পদ্ধতিতে রান্না করা হয়। এর স্বাদ ও গন্ধ অন্য যে কোনো ধরনের ভাত জাতীয় খাবারের থেকে আলাদা। এ ভাত রান্না করতে হলে আধা সেদ্ধ চাল কমপক্ষে সাতদিন মাটির হাঁড়িতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। অনেকে ৮-৯ জলে ভিজিয়ে রেখেও এ ভাত রান্না করে থাকে। অন্তত সাতদিন পর জমানো জলসহ চাল থেকে এক ধরনের টক গন্ধ বের হলেই বোঝা যায় তা কাজীর ভাত রান্নার জন্য তৈরী। রান্নার সময় জলে ভিজিয়ে রাখা চাল ভালো করে ধুয়ে সাধারণ রান্নার মতোই ভাত রান্না করা হয়। ভাত হয়ে এলে টক গন্ধ বের হয়।
অনেকে আবার মশলাদার খিচুড়ির মতো করেও রান্না করে থাকে। অতীতে কাজীর ভাতের জন্য চাল ভিজিয়ে রাখার জন্য শুধুমাত্র নতুন বা পুরনো মাটির হাঁড়ি ব্যবহার করার রেওয়াজ থাকলেও বর্তমানে যে কোনো পাত্রেই চাল ভিজিয়ে রাখা হয়। কাজীর ভাতের সঙ্গে আয়োজন করা হয় নানান পদের ভর্তার। বলা হয়, ভর্তা যত বেশি হবে, কাজীর ভাতের স্বাদ তত বাড়বে। ভর্তার মধ্যে রয়েছে কালো জিরা ভর্তা, কাঁচা মরিচের সঙ্গে রসুন ভর্তা বাদাম ভর্তা। এছাড়াও আছে কুমড়োর ভর্তা, পটলের খোসা ভর্তা, বেগুন ভর্তা, কচু ভর্তা, চিংড়ি মাছ ভর্তা, ইলিশ মাছের মাথা ভর্তা, পেঁয়াজ-মরিচ ভর্তা, আলু ভর্তা, ডাল ভর্তা, সরিষা ভর্তা, ছোট মাছের শুঁটকি ভর্তা ও টাকি মাছ ভর্তা।
কাজীর ভাতে টক স্বাদ ও টক গন্ধ বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছেই অপছন্দের। তবে প্রবীণদের কাছে আজও প্রিয় কাজীর ভাত। এখনকার গৃহবধূদের অনেকেই রান্না করতেই জানেন না কাজীর ভাত। প্রগতির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে এভাবেই অযত্নে আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যগুলিকে।
তথ্য এবং চিত্র ঋণ – মহঃ সাইফুল ইসলাম, বাংলাদেশ
Discussion about this post