মধ্যযুগের ভারত ধর্মীয় কট্টরতার জ্বলতে থাকা সমিধে দেখেছিল ভক্তি ও মুক্তির অনন্য সাধারণ স্ফুলিঙ্গ। ধর্ম ও জাতপাতের জটিলতায় জর্জরিত প্রকান্ড এই ভূখন্ডের বুকেই সুফিবাদের মতো বিশ্বাসের জন্ম হয়। আড়ম্বরকে ছেঁটে ফেলে নির্মল সাধনা, অনুরাগ ও সমর্পণের মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানটাই ছিল সুফিবাদের উদ্দেশ্য। সহজ সরল মতবাদটি উত্তর-পশ্চিম, উত্তর ও পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পড়ে অনায়াসেই। সুফিবাদের পীর-মুরিদ পরম্পরা ভারতের সনাতন গুরু-শিষ্য সংস্কৃতির কাঠামোর সঙ্গে মিলে মিশে যায় খুব সহজেই। দীন-দুঃখী অসহায় মানুষের কাছে স্রেফ ভালোবাসার বিনিময়ে ঈশ্বর প্রাপ্তির সুযোগ সুফিবাদকে গ্রহণযোগ্য করে তোলে সাফল্যের সঙ্গে। ধর্ম ও জাতপাতের সংকীর্ণতার উর্ধ্বে গিয়ে পীর-দরগায় তাই বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা ভক্তি ভরে করে এসেছেন কদমপোষী। নিরাশার কালোয় আলোর সন্ধান নির্বিবাদে আজও ভারতের দরগাগুলোয় চলছে, ব্যতিক্রম যায়নি ওয়ালী পীর জুম্মা শাহ বাবার দরবারও।
বড়বাজারের অন্যতম ব্যস্ত বাণিজ্যিক অঞ্চল হল ত্রিপলপট্টি। হাওড়া থেকে অফিসপাড়া ডালহৌসি যাওয়ার রাস্তায় যে আর্মেনীয় গির্জা পড়ে, ঠিক তার পাশ দিয়ে সংকীর্ণ রাস্তাটির মুখে রয়েছে জুম্মা শাহ বাবার দরগা। সুফিবাদের মূলে বৈষম্য পেরোনো সহাবস্থান, সহানুভূতি ও সহিষ্ণুতার সুদীর্ঘ ইতিহাসের প্রমাণ মেলে দরগার অবস্থানের দিকে তাকালেই। দরগার বিপরীতে রয়েছে রাজস্থানী মূলের অধিবাসীদের উপাস্য- রাধা কৃষ্ণের সাওঁয়ারিয়া শেঠ মন্দির। ঘিঞ্জি এলাকার মাথা জুড়ে জটা বিস্তার করেছে যে বৈদ্যুতিন তারের জটলা, এক ঝলক দেখলে মনে হয় হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির সুনিবিড় সম্পর্ককেই বিবৃত করছে। মাদারিয়া সিলসিলার জাগ্রত পীর জুম্মা শাহ বাবা স্থানীয় মুসলমান, হিন্দু, শিখ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সমান জনপ্রিয়। বাবার দরবারে সবার প্রবেশ অবাধ।
কাদারিয়া সিলসিলা জনপ্রিয়তা অর্জন করে মুঘল আমলে। উল্লিখিত সিলসিলার মূল ঘাঁটি রয়েছে উত্তরপ্রদেশের মেওয়াট অঞ্চলের মাকানপুরে। কালক্রমে সিলসিলার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে বিহার ও বঙ্গভূমিতে। মাদারিয়া সিলসিলার ঢেউ ভিজিয়েছে নেপাল ও বাংলাদেশের মাটিও। স্থানীয় অধিবাসী ও বাবার মুরিদ শেখ আলতাফ বলেন জুম্মা শাহ বাবার দরগা পরিচালনায় একটা বড় ভূমিকা পালন করেন স্থানীয় মারোয়াড়ি ও শিখ ব্যবসায়ী মন্ডলী। বাবার উরসে প্রতিবছর উৎসব হয় দেখার মতো। চলে জনসংযোগ বৃদ্ধি ও জনকল্যাণকামী উদ্যোগ। দুঃস্থ মানুষজনদের বস্ত্রদান ও চক্ষু পরীক্ষার সঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনও করা হয় বিপুল উৎসাহে। জুম্মা শাহ বাবার ‘তাবারুখ’ বা প্রসাদ নেওয়ার ভিড় থাকে দেখার মতো। আশীর্বাদকামী মুরিদরা ধর্মের বেড়াজাল, ভাষার দেওয়াল ও অর্থের বৈষম্য ভুলে লঙ্গরে পাশাপাশি বসে ভোগ খান পরম শ্রদ্ধায়। জুম্মা শাহ বাবার দরগা আরও একবার বলে দেয়, এক ও অখণ্ড ঈশ্বরকে স্পর্শ করার মাধ্যম একমাত্র ভালোবাসাই।
Discussion about this post