উৎসব ও সংস্কৃতির পীঠস্থান বাংলা। বাঙালির সংস্কৃতি প্রায় ৪ হাজার বছরের পুরনো। বাঙালি সংস্কৃতি ধর্মীয় ও জাতীয় দিক দিয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বাংলা সংস্কৃতির উৎসবগুলি পৃথিবীব্যাপি উৎযাপিত হয়। সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতে সর্প পূজা প্রাচীন সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। সর্প সমস্যার সমাধানের জন্য ধার্মিক মানুষেরা সর্পের অধিষ্ঠাত্রী এক দেবীর কল্পনা করেন। যিনি কালক্রমে বঙ্গদেশে মনসা নামে পরিচিত। বাংলার গ্রামাঞ্চলের প্রচলিত ঝাপান পূজো পালিত হয় মা মনসাকে কেন্দ্র করেই। ঝাপান উৎসবের কথায় প্রথমেই মনে আছে পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বরে কথা। এখানকার ঝাপান উৎসবের খ্যাতি বর্ধমান তথা পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে আছে।
মন্তেশ্বরের খান্দড়া ও বামুনিয়া গ্রামে মহা ধুমধামে পালিত হয় ঝাপান উৎসব। লোকমুখে শোনা যায়,খান্দড়া গ্রামের গ্রাম্য দেবী মনসা মূর্তিটি কষ্টিপাথরের তৈরি। এক সময়ে এলাকার জমিদার সরকার পরিবারের কূলদেবী ছিলেন এই মা মনসা। আজ থেকে প্রায় দুই শতাধিক বছর আগে এলাকা ছাড়া হয়ে যায় সরকার পরিবার। পড়ে থাকে তাঁদের বসত বাড়ি ও কূলদেবী। জমিদার বাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও গ্রামবাসীরা সযত্নে রেখে দেয় তাঁদের কূলদেবীকে। প্রতিবছর ২৮ ও ২৯ ভাদ্র খান্দড়া গ্রামে মা মনসার পূজো হয়। পূজোর শুরুর দিকে খান্দড়া গ্রামের মনসা মূর্তি বামুনিয়া গ্রামে নিয়ে যাওয়া হত। কিন্তু ৪০-৫০ বছর আগে একবার এই মূর্তি নিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুই গ্রামের সাধারণ মানুষ। এই ঘটনায় অনেকে আহতও হন। তারপর থেকেই সেখানে মূর্তি নিয়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তবু প্রাচীন প্রথা মেনে খান্দড়া গ্রামের সঙ্গে একই দিনে মনসা পূজোয় মেতে ওঠেন বামুনিয়া গ্রামবাসীরাও।
জমিদারের চলে যাওয়ার পর খান্দড়া গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায় একটি মাটির ঘরে দেবীকে রেখে নিত্যসেবার পূজো করা হত। তবে প্রায় বছর ত্রিশ আগে এই জায়গায় একটি মন্দির নির্মাণ করে দেন মৃগাঙ্ক চক্রবর্তী নামে গ্রামের এক হাইস্কুল শিক্ষক। প্রায় ১২০ বছরের প্রাচীন এই উৎসব পরম নিষ্ঠার সাথে পালিত হয়। দেবীর সেবাইত সুখেন মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “পূজোর দু’দিন দেবীকে গোটা গ্রাম ঘোরানোর প্রথা রয়েছে। সেই প্রথা মেনে প্রতিটি পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে ঘোরানো হয় দেবীকে। রয়েছে বলিদান প্রথাও। পুজোর দু’দিন ৪০০-৫০০ মেষ, ছাগল, শুকর ও হাঁস বলি হয়। পূজোর শেষ দিনে দেবীকে পঞ্চগব্য করে মূল মন্দিরে এনে রাখা হয়। মায়ের কাছে আসা সকল ভক্তদের মনস্কামনাও পূর্ণ হয়।”
মা মনসার এই ঝাপান উৎসব ঘিরে নিঙার পাড়ের ফুটবল মাঠে, খান্দড়ার পাশে মেমারি- মালডাঙ্গা সড়ক পথের ধারে ও বামুনিয়া গ্রামসহ একাধিক জায়গায় মেলা বসে। এই উৎসবে মেতে ওঠেন সকল গ্রামবাসী। এই সময় গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে আসে প্রচুর আত্মীয়স্বজন । প্রতিটি পাড়ার বাসিন্দারা তাঁদের নিজেদের মত করে গানবাজনার আয়োজন করে। খান্দড়া গ্রামের মনসার ঝাপান ঘিরে সরগরম হয়ে ওঠে গোটা এলাকা।
Discussion about this post