ভোজন রসিক বাঙালির শীতের আমেজের সাথে জড়িয়ে জয়নগরের মোয়ার আবেগ। বিভিন্ন সব্জির পাশাপাশি বাঙালির শীতের খাদ্যতালিকায় রয়েছে পিঠে, পাটিসাপ্টা, নলেন গুড়ের রসগোল্লা, সন্দেশের মতো নানারকম মিষ্টি। তবে এসব মিষ্টির সঙ্গেই বাঙালির পাতে বড়ো জায়গা করে নিয়েছে,এই জয়নগরের মোয়া।তবে এই মোয়ার জন্মস্থান নিয়ে বহুকাল ধরেই রয়েছে নানা বিতর্ক। মোয়া বলতেই বাঙালি বোঝে জয়নগর। কিন্তু সত্যিই কি তার উৎপত্তিস্থল সেখানে? এর উত্তর পাওয়ার জন্য,জেনে নেওয়া প্রয়োজন জয়নগরের মোয়ার ইতিহাস!
মোয়ার নামের আগে জয়নগরের নাম জড়িয়ে থাকলেও, এর আসল জন্মভূমি বহরু নামক গ্রাম। অর্থাৎ বলা যেতে পারে বহরু হলো, জয়নগরের মোয়ার আঁতুড়ঘর। ‘রায়মঙ্গল’ কাব্যে যে ‘বড়ুক্ষ’র উল্লেখ লক্ষ্য করা যায়, তারই বর্তমান নাম বহরু। এই গ্রামেই শৈশব কেটেছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের। গ্রামের জনৈক যামিনীবুড়ো এই মোয়ার জন্মদাতা হিসাবে পরিচিত।শোনা যায়, তিনি নিজের জমিতে কনকচূড় ধান ফলান। পরে সেই ধানের খই ও নলেন গুড় দিয়ে মোয়া তৈরি করে কোনও এক অনুষ্ঠানে তা পরিবেশন করেন। সেই অনুষ্ঠানেই খোদ হাজির ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব। তিনি মোয়ার খুব সুখ্যাতি করেন। এরপরই লোকমুখে জনপ্রিয়তা লাভ করে বহরু থুড়ি জয়নগরের মোয়া।
সুখ্যাতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই মোয়ার চাহিদা বাড়তে থাকে। ফলে মোয়া প্রস্তুতকারকদের ব্যবসায়িক উন্নতি ঘটতে থাকে।যামিনীবাবুর মোয়ায় খই ও নলেন গুড় ব্যতিত আর বিশেষ কিছু ছিলো না। এই মোয়াকেই পরবর্তীকালে নতুন রূপে ও স্বাদে প্রস্তুত করেন জনৈক পূর্ণচন্দ্র ঘোষ (বুঁচকি বাবু) ও নিত্যগোপাল সরকার। ১৯২৯ সালে তাঁরা বহরুতে একটি মোয়া তৈরির দোকান স্থাপন করেন। এইভাবেই যাত্রা শুরু হয় ‘ শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ ওরফে ‘বুঁচকি বাবুর দোকান’-এর। সেইসময় প্রাচীন জনপদ বহরুতে কোনও বাজার না ছিল না। কাজেই মোয়া প্রস্তুতকারকদের তা বিক্রি করতে যেতে হতো জয়নগর হাটে।এর ফলেই,ক্রেতাদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে বহরুর পরিবর্তে জয়নগরের মোয়ার নাম।
তবে ২০১৫ সালে জি আই ট্যাগ পাওয়া জয়নগরের মোয়ার ব্যবসা বর্তমানে খানিউক পড়তির দিকে। তার একটা বড়ো কারণ কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের তৈরি করা ভেজাল মোয়া। শুদ্ধ নলেন গুড়ের পরিবর্তে তাতে মেশানো হচ্ছে চিনি, চায়ের লিকার কিংবা ভেলী গুড়। যার ফলে, মোয়ার গুণগত মান অনেক কমে যাচ্ছে। দাম বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে নকল মোয়ার বিক্রি।মোয়ার স্বাদ নিয়ে তৈরি হচ্ছে নানারকম সমালোচনা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আদি মোয়া ব্যবসায়ীরা। তাই ক্রেতাদের খুব সতর্কভাবে জি আই ট্যাগ দেখেই মোয়া কিনতে হবে। মোয়ার সুখ্যাতি বিদেশ পর্যন্ত ছড়িয়েছে। তাই ভেজাল মোয়ার বিক্রি বন্ধ হওয়া উচিত। তবেই না খাদ্যরসিক বাঙালির রসনার বাসনা সম্ভব হবে।
Discussion about this post