ভারতে তো বটেই, সারা বিশ্বে ধর্মের রাজনীতি চলছে। চলছে যুদ্ধ, ষড়যন্ত্র, মৃত্যু, দোষারোপ, চাপান-উতোর। এক ধর্মের মানুষ, অপর ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে রক্তচক্ষু দেখাচ্ছেন। এই ছবিই আমাদের দেশে অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। ‘শক-হুণ-পাঠান-মোগল এক দেহে হল লীন’ বা ‘বিবিধের মাঝে মিলন মহান’-এর চিত্র আজ যেন বড়ই বিরল। ধ্বংস আর যুদ্ধের পরিবেশই ভবিতব্য। এর মধ্যে যখন এই বাংলাতেই উল্টো ছবি দেখা যায়, তখন মন খুশি হয়ে ওঠে বইকি!
কথা হচ্ছে উত্তর দিনাজপুরের ইটাহার ব্লকের চূড়ামন রাজবাড়ির দুর্গা পুজো নিয়ে। দুর্গা শাস্ত্রগতভাবে হিন্দু দেবী। দেবীর পূজার্চনা থেকে শুরু করে যাবতীয় রীতিনীতি, নিয়মাবলী পালন করার কথা হিন্দু পুরোহিতের। কিন্তু যুগ যুগ ধরে প্রতিবছর এই রাজবাড়ির দুর্গা পুজো শুরু হয় পীরের দরগার ধ্বজা উড়িয়ে। অবিশ্বাস্য লাগছে তো? পুজোর শেষ দিনও কিন্তু আবারও সেই ধ্বজা উড়িয়েই পালিত হয় বিজয়া দশমী এবং আরও অবাক করা বিষয় হল, ইসলাম সম্প্রদায়ের মানুষের হাত দিয়েই ওড়ানো হয় সেই ধ্বজা।
ইটাহারের কোনও এক পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ষোড়শ শতকে এই পুজোর সূচনা করেছিলেন রাজা জগৎবল্লভ রায়চৌধুরী। আর সেই সূচনার সময় থেকেই, পুজোর মধ্যে ধর্মের বেড়াজাল কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। জাঁকজমকের সঙ্গে আয়োজন করা হত দেবী আবাহনের। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ আন্তরিকতার সঙ্গে আনন্দে মেতে উঠেছিলেন, এবং এখনও সেই আনন্দ কমেনি এতটুকুও।
তবে বর্তমানে পুজোর জৌলুস কমেছে অনেকখানি। চূড়ামন রাজবাড়ির সেই বৈভবও আর নেই। বিশাল রাজবাড়িটি পরিণত হয়েছে ধংসস্তূপে। পূজোর মন্দির এবং পারিবারিক ঠাকুরদালান সবই ডুবে গিয়েছে স্থানীয় মরাসুঁই নামক নদীটির গর্ভে। তবে পুজো কিন্তু বন্ধ হয়নি। হেরফের হয়নি যুগ যুগ ধরে চলে আসা সম্প্রীতির মধ্যেও। দেশজুড়ে হিংসা ও হানাহানির মধ্যেও বাংলার এই ছোট্ট জায়গায় মানুষ বাঁচিয়ে রেখেছেন মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও সম্প্রীতিবোধ। স্থানীয় মানুষদের সাহায্যেই আবার তৈরি হয়েছে নতুন মন্দির। রাজবাড়ির পুজোতেও তাঁদের সহযোগিতা চোখে পড়ার মতই। গোটা পুজোর আয়োজন এবং ব্যবস্থাপনা অবশ্য দেখভাল করেন রাজ পরিবারের দশম পুরুষ কৌশিক রায়চৌধুরী।
Discussion about this post