“ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে।” এই ঘুম পাড়ানি গানটি মা, ঠাকুমার মুখে আমরা অনেকেই শুনেছি ছোটবেলায়। শুনেছি দাদু, ঠাকুরদার কাছে সেই বর্গীদের বাংলা আক্রমণের অনেক গল্প। আবার পড়েছি ইতিহাসের পাতায় তার বর্ণনা। আঠেরো শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলা, বিহার এবং ওড়িশা জুড়ে শুরু হয় মারাঠা দস্যুদের ভয়ঙ্কর আক্রমণ। এই দস্যুদের বাংলায় বলা হত বর্গী। বাংলা ও ওড়িশার অবস্থা এইসময় রক্তাক্ত। এতটাই ভয়ানক ছিল সেই দিনগুলো, যে ছেলে ভোলানোর জন্যে আজও এই গানের ব্যবহার হয় বাংলায়।
প্রায় দশ বছর ধরে চলে এই লুঠতরাজ। কিন্তু এই দস্যুদের মধ্যে অনেকেই বাংলা ছেড়ে যাননি। আপন করে নিয়েছে বাংলার সংস্কৃতিকে। তারই একটি নিদর্শন আমরা দেখতে পাই আজও। হুগলির ইটাচুনা গ্রামে এর এক মস্ত সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি আস্ত রাজবাড়ি।
এই রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেছিল সেই সেনাবাহিনীর অন্যতম কুন্দ্রারা। যারা পরবর্তীকালে এই বাংলার সাথে ওতপ্রোতভাবে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। এখানেই বাস করতে থাকে ও তৈরি করে এই রাজমহল। তারা লুঠের সম্পত্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করে এই রাজবাড়ির। ধীরে ধীরেই এই কুন্দ্রা পদবী পাল্টে যায় কুণ্ডুতে। সাফল্যরাম কুণ্ডু নামের এই পরিবারের এক সদস্য ২০ বিঘা জমির উপর এই রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৭৬৬ সালে। পরে এই পরিবারের আরো দুই সদস্য নারায়ণ কুণ্ডু ও বিজয়নারায়ণ কুণ্ডু এই বাড়ির কাঠামোতে একটু পরিবর্তন আনেন।
তবে উল্লেখ্য যে পদবীর বিবর্তন কিংবা বাংলার সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণ আপন করে নিলেও তাদের বর্গী পরিচয় পুরোপুরি মুছে যায় নি। এই ইটাচুনা রাজবাড়িরকে আজও স্থানীয় মানুষ ‘বর্গীডাঙা’ বলেই বেশি চেনে। তবে এই রাজবাড়িকে আরো নতুন করে সাজানো হয়েছে পর্যটকদের জন্য। রয়েছে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থাও। এখানে কাঁসার বাসনে একেবারে খাঁটি বাঙালি রান্নাও পরিবেশন করা হয়৷ বিভিন্ন সিনেমার শুটিংও চলে এই স্থানে। একসময় বাংলা কাঁপানো এই বর্গীদের বাড়ি আজ বাংলার একটি অন্যতম নিদর্শন হয়েছে। যার আনাচেকানাচে রয়েছে বাংলার ইতিহাস।
চিত্র ঋণ – অনিমেষ হালদার, পিনাক পাণি, কিঞ্জল বসু, দেবরূপা রায় সিংহ
Discussion about this post