১৯৫৩ সালের ২৬ মার্চ পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি হয়েছিল এক মাইলফলক। কারণ এই দিনেই প্রথম পোলিও রোগের টিকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। ফলে পোলিওর যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পায় বহু মানুষ। বাঁচে লক্ষ লক্ষ জীবন। তবে সেই সময়ও বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিই পোলিও টিকার ‘পেটেন্ট’ করানোর জন্য তখন উঠে পড়ে লেগেছিল। তবে এই টিকার আবিষ্কর্তা শোনামাত্রই তা নিষেধ করে দেন। নাহ! নিজের নামে তিনি নিতে চাননি কোনও পেটেন্ট। কারণ তিনি চেয়েছিলেন প্রাণ বাঁচাতে। চেয়েছিলেন যাতে এই টিকার সাহায্যেই কষ্টের সুরাহা হয় বহু মানুষের। তিনি হলেন মার্কিনি গবেষক এবং ভাইরাসবিদ এডওয়ার্ড জোনাস সাল্ক। যিনি এই পৃথিবীর বুকে প্রথম আবিষ্কার করেন পোলিও রোগের ভ্যাকসিন।
বিংশ শতকের গোড়ার দিকে পোলিও একটি ভয়ঙ্কর রোগ রূপে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। প্রতি বছর প্রায় হাজার হাজার শিশু পঙ্গু হয়ে যেতে থাকে এই রোগের কবলে। বাঁচার তখন একটাই উপায়। পোলিওর টিকা বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার। ঠিক তখনই এগিয়ে এলেন এডওয়ার্ড সাল্ক। তিনি তখন অন্য একটি গবেষণার কাজে মত্ত। তবু সেসব ছেড়ে তিনি পোলিও ভ্যাকসিন বা টিকা তৈরিতে নিজেকে উৎসর্গ করলেন। ১৯৫৩ সালের মধ্যে তৈরিও হল সেই টিকা। প্রথমে নিজের এবং নিজের পরিবারের ওপরই এই টিকা পরীক্ষা করেন সাল্ক। সফল হওয়ার পরই জনসাধারণের উদ্দেশ্যে এটি ঘোষণা করা হয়। ১৯৫০-৬০’র দশকে এই টিকার সাহায্যেই খুব তাড়াতাড়ি পোলিও আক্রান্ত দেশগুলির জনস্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণে আনা গিয়েছিল। কিন্তু একটি টিকা যখন আবিষ্কার হচ্ছে তখন তা ব্যবসায়িক কাজে তো ব্যবহার করা হবেই! ঠিক এই কারণেই তখন দেশের বিভিন্ন নামী দামী ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা এই টিকা ‘পেটেন্ট’ করানোর জন্য এডওয়ার্ডের দারস্থ হয়। কিন্তু এডওয়ার্ড ছিলেন অন্য ধাঁচের মানুষ। তিনি কখনই চাননি তার এই আবিষ্কার ব্যবসায়িক কাজে লাগুক। বরং তিনি সব সময়ই চেয়ে এসেছিলেন এই টিকা যেন মহান উদ্দ্যেশ্যে কাজে লাগে। পৃথিবীর সব শ্রেণীর মানুষের প্রাণ বাঁচানোর কাজে যেন সফল হয় এই টিকা। তাই-ই তাঁর এই আবিষ্কার। পেটেন্ট তিনি করাবেন না। এমনকি করানও নি। পরে এক টেলিভিশন ইন্টারভিউতে যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয় এই ভ্যাকসিনের পেটেন্ট কার? তখন তাঁর উত্তর ছিল- “ওয়েল… দ্য পিপল আই উড সে। দেয়ার ইজ নো পেটেন্ট… ক্যান ইউ পেটেন্ট দ্য সান?” অর্থাৎ সূর্যকে কি কেউ কখনও পেটেন্ট করতে বা কিনতে পারে?
আবিষ্কারের প্রথম কয়েক বছরেই ভ্যাকসিনটি পোলিও আক্রান্তদের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল। ফিলাডেলফিয়ার কলেজ অফ ফিজিশিয়ানদের মতে ১৯৫২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫৭ হাজারেরও বেশি পোলিও আক্রান্ত ছিল। তার এক দশক পরেই সেই সংখ্যাটি হাজারে নেমে আসে। বেশ কিছুকাল পরে অবশ্য পোলিওর টিকা হিসাবে সাল্কের তৈরি এই ভ্যাকসিনটি সরিয়ে অ্যালবার্ট সাবিন আবিষ্কৃত একটি লাইভ ভাইরাস ভ্যাকসিন ব্যবহার হতে শুরু করে। কারণ সেটি ছিল কম ব্যয়বহুল এবং সহজে ব্যবহারযোগ্যও বটে। তবে প্রথম পোলিও টিকা আবিষ্কারক হিসাবে সাল্কের কৃতিত্ব কোনও ভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই।
Discussion about this post