বাঙালির আবার ব্যবসা! এই কথা আমরা প্রায়শই শুনে থাকি। শুধু আজ বলে নয়, অনেক আগে থেকেই বেশিরভাগ লোকের মনেই গেঁথে গেছিল এই কথা। তবে সব ক্ষেত্রে একথা সত্য প্রমাণিত হয় কি? না একেবারেই নয়। ঔপনিবেশিক ভারতেও এর অন্যথা হয়নি। অনেক বাঙালি নিজের দমেই লড়াই করে নিজেদের ভিত প্রতিষ্ঠা করেছে ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতের বুকেই। ফণীন্দ্রনাথ গুপ্ত হলেন তাদের মধ্যে অন্যতম এক বাঙালি। এফ.এন নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তথাকথিত পরিচিতি লাভ করতে না পারলেও সফল ব্যবসায়ী হিসেবে তাঁকে মানুষ মনে রেখেছেন আজও। ঔপনিবেশিক শাসনকালে তাঁর গড়ে তোলা ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের সম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি নিজেকে। কিন্তু কী ছিল তার ব্যবসার মূল উপাদান?
ফাউন্টেন পেন, বাংলায় যাকে আমরা বলে থাকি ঝর্ণা কলম। আজকাল বলপেনের যুগে আমরা এই ঐতিহ্যবাহী পেনকে প্রায় হারিয়েই ফেলেছি। ১৮৮৩ সালে লুইস ওয়াটারম্যান আবিষ্কার করেন এই ফাউন্টেন পেন। কিন্তু দেশভক্ত ব্যবসায়ী ফণীন্দ্রনাথ গুপ্ত বিংশ শতাব্দীতে প্রথম দেশীয় উপায়ে ঝর্ণা কলম এবং পেন্সিল তৈরির প্রক্রিয়া চালু করেন। শুধু তাই নয়, এফ. এন. গুপ্ত অ্যান্ড কোং নামে নিজস্ব একটি কোম্পানি তৈরি করেছিলেন তিনি। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে তাঁর সততা ও কাজের নীতি দেখে এবং তৎকালীন আইসিএস কর্মকর্তা ও চট্টগ্রামের কমিশনার কে.সি.ডি এবং ভারতের মুদ্রণ ও স্ট্যাম্প নিয়ন্ত্রক এম. জে. কগসওয়েল-এর সুপারিশে ব্রিটিশ সরকার এই কোম্পানির সঙ্গে একটি বার্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ব্যস, এরপর আর ব্যবসা নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি দেশীয় এই ব্যবসায়ীকে।
দিন যত এগিয়েছে ফণীন্দ্রনাথ তাঁর ব্যবসার ভিত আরও বেশি করে মজবুত করতে অভিজাত খদ্দেরদের উপযোগী স্টেশনারি জিনিসপত্র তৈরি করতে শুরু করেন। এর মধ্যে একটি হল এক্সক্লুসিভ ‘দ্য পারফেকশন ফাউন্টেন পেন’ সিরিজ। এই ফাউন্টেন পেনগুলির বিশেষত্ব হল এর নিব তৈরি হত ১৪ ক্যারেট সোনা দিয়ে। এমনকি বাইরের খোলসটি ছিল মাদার অফ পার্লের তৈরি। ১৯২৫ সালের ২৮ অগাস্ট, ফণীন্দ্রনাথের কারখানা পরিদর্শন করতে এসেছিলেন স্বয়ং মহাত্মা গান্ধি। তিনিও তাঁর ব্যবসায়িক উদ্যোগে খুশি হয়ে প্রভূত প্রশংসায় ভূষিত করেছিলেন দেশীয় এই ব্যবসায়ীকে।
ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে তাঁর প্রধান গুণ ছিল এই যে তিনি পণ্যের গুণগত মানের সঙ্গে কখনই আপোস করেননি। পণ্যের গুণগত মান সম্পর্কে খুবই খুঁতখুঁতে ছিলেন ফণীন্দ্রনাথ। তাঁর অসাধারণ সব ক্রিয়াকলাপে মুগ্ধ হয়ে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘রায় বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। এত বিদেশি খেতাব কোড়ানোর পরেও নিজের মাটিকে কখনই অসম্মান করেননি তিনি। একথা সত্য, স্বদেশি আন্দোলনের যুগে যখন বেশিরভাগ ছাত্ররা একচেটিয়া আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল তখন ফণীন্দ্রনাথ গুপ্ত কোনোদিনই সরাসরি যোগ দেননি এই আন্দোলনে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে দেশকে স্বাবলম্বী করতে হলে প্রথমে দেশীয় শিল্পের শিকড়কে মজবুত করে স্থাপন করতে হবে।
Discussion about this post