১৯৭১ এর ২৬ শে মার্চের সকাল। অবশেষে “সোনার বাংলা”র আকাশে স্বাধীন সূর্যের উদয়। হ্যাঁ ,বাঙালি গর্জে উঠেছিল সেদিন। একদিকে দেশমাতা পেয়েছিল তার বীর সন্তানদের ,যাদের “সোনার বাংলা শ্মশান কেন?” স্লোগানে জেগে উঠেছিল দেশ অন্যদিকে কোল শূন্য হয়েছিল হাজার হাজার বাঙালি মায়ের।
মাগফারউদ্দিন চৌধুরী আজাদ, ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে জ্বলজ্বল করছে যাঁর নাম। ১৯৬০ এর দশক,আজাদের পিতা ছিলেন সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম ধনী ব্যক্তি। তাঁদের বাড়ি তো নয় যেন রাজপ্রাসাদ, সবেতেই ঐশ্বর্য্যের ছোঁয়া। সেই সময়ে অনেক সিনেমার শুটিং ও হয়েছিল তাঁদের বাড়িতে। আজাদ তখন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। তাঁর বাবা দ্বিতীয় বিবাহের সিদ্ধান্ত নেন । কিন্তু তাতে আজাদের মা, সাফিয়া বেঁকে বসেন। তিনি পণ করেন, আজাদের বাবা এই বিয়ে করলে তিনি তাঁর ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ত্যাগ করবেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর বাবা এই বিয়ে করেন। আজাদের মাও বাড়ি ত্যাগ করেন।নিজেদের সামর্থ্য মত আশ্রয় নেন কুটিরে। কিন্তু মায়ের যে অনেক স্বপ্ন! ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করবেন। পরবর্তীকালে আজাদ কে পাঠানো হয় পশ্চিম পাকিস্তানে,পড়াশোনার জন্য। ঢাকায় ফিরে এসে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তখন ‘৭১ সাল। একদিকে বাঙ্গালীদের চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন, অন্যদিকে রাজাকার বাহিনীর নৃশংস অত্যাচার। আজাদরাও থেমে থাকে না। কিন্তু এই পৃথিবীতে আজাদ ছাড়া তাঁর মায়ের আর কেউ নেই। তাই ছেলে আগে মায়ের কাছে অনুমতি চায়। দেশের এখন তাঁকে প্রয়োজন তিনি কি করে আটকান তাঁর সন্তানকে? যুদ্ধে যাওয়ার জন্য মায়ের কাছ থেকে অনুমতি পান আজাদ। অংশ নেন দুটি অপারেশনে।বাড়িতে লুকানো হয় অস্ত্রশস্ত্র। ২৯ শে আগস্ট, আজাদকে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গ্রেফতার করে। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় এম.পি হোস্টেলে মিলিটারি টর্চার সেলে। কারাগারে অকথ্য অত্যাচার চলতে থাকে মুক্তিযোদ্ধার ওপর।
এরই মাঝে আজাদের মা কারাগারে তাঁকে দেখবার অনুমতি পান। সেই বীভৎস অত্যাচারে আজাদের চেহারা পাল্টে গিয়েছে পুরোপুরি। মা চিনতে পারেন না তার ছেলেকে। মায়ের চোখের জলেই মনের আগুন আর ও তীব্র হয় । মাকে কথা দেয়, যতই অত্যাচার করা হোক না কেন, সে কিছুতেই বাকি মুক্তিযোদ্ধাদের নাম উচ্চারণ করবে না। কিন্তু তখন তাঁর পেটে ক্ষুধার জ্বালা। মায়ের কাছে ভাতের জন্য আবদার করে ছেলে। আর সাফিয়া বেগম যেন জীবনের সবথেকে অসহায় মুহূর্তের সম্মুখীন হন। ছেলের মুখে এখন অন্ন জোগান দেবেন কোথা থেকে? পরদিন তিনি আজাদের জন্য ভাত নিয়ে হাজির হন রমনা থানার সামনে। কিন্তু তাঁর হদিশ পান না কোথাও। সন্তান ভাত খেতে চেয়েছিল, তিনি এক মুঠো খাবারও তুলে দিতে পারেননি তা্ঁর মুখে।এই কষ্টের তীব্র দাবদাহে জ্বলতে থাকে তাঁর মায়ের মন। ছেলে আবার আসবে, এই আশায় তিনি বসে থাকেন পরবর্তী ১৪ টি বছর। ১৪ বছর কখনও মুখে তোলেননি ভাত। বিছানার আরাম ত্যাগ করে, রাত্রিযাপন করেছেন ঘরের মেঝেতে। দরজার মুখপানে বসে থাকেন ছেলের অপেক্ষায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন সফল হয়েছিল এইরকম হাজার হাজার আজাদদের মায়ের জন্যই। তেলের প্রদীপের সলতে তো তাঁরাই পাকিয়ে ছিলেন সুন্দরভাবে। এই বাঙালি জাতি যদি তাদের ভুলে যায়, তবে তার চেয়ে বড় অভাগা আর হয়তো কেউ নেই!
Discussion about this post