প্রিয়জনের জন্য কত কিছুই না করার চেষ্টা করেন মানুষ! নিজের কাছের মানুষকে খুশি করার উদ্দেশ্যে কতই না প্রতিশ্রুতির অঙ্গীকার করেন তাঁরা। কিন্তু বাস্তবে ঠিক কত জনই বা সেই অঙ্গীকার রাখতে পারেন? সবাই হয়তো পারেন না, তবে কিছু কিছু জন পারেন বৈকি। সেরকমই একজন, জাপানের তোশিইউকি কুরোকি। নিজের অন্ধ স্ত্রীর মুখে হাসি ফোটাতে তিনি বানিয়েছেন আস্ত এক ফুলের বাগান। বর্তমানে জাপানের বিখ্যাত এক পর্যটন কেন্দ্র সেটি।
কুরোকির বাগান গড়ার ইতিহাস খুঁজতে গেলে আমাদের নজর ফেরাতে হবে অতীতে। সালটা তখন ১৯৫৬। জাপানের সিনতোমির ছেলে তোশিইউকি প্রেমে পড়েন মিয়াজাকির মেয়ে ইয়াসুকোর। এক মেলাতে প্রথম আলাপ হয় তাঁদের। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই দুজনে বুঝতে পারেন, একে অপরকে ছেড়ে থাকা প্রায় অসম্ভব। ব্যাস আর কি! বিয়ে করে ফেললেন দুজনে। এরপর কেটে গেল দীর্ঘ তিরিশটা বছর। এই তিরিশ বছরে কতই না উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। তবু এক মূহুর্তও একে অন্যের হাতটি ছাড়েননি। একসঙ্গে গড়েছেন ফার্ম, দেখেছেন একসঙ্গে অবসর কাটানোর স্বপ্নও। একসঙ্গে তাঁরা ঘুরে দেখবেন সারা জাপান। নিজের চোখের আবিষ্কার করবেন জাপানের সৌন্দর্য।
হঠাতই ঘটে ছন্দপতন! তাঁদের সেই স্বপ্ন যেন স্বপ্নই থেকে গেল। ডায়াবেটিসের কারণে নিজের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেললেন ইয়াসুকো। একেবারে ভেঙেই পড়লেন তিনি। প্রচন্ড মানসিক আঘাতে সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ করে চার দেওয়ালের মধ্যেই নিজেকে বন্দী করে নিলেন। চোখে যদি নাই দেখতে পান তবে কিভাবেই বা জাপান ঘুরে দেখবেন তাঁরা? এই চিন্তাতেই ভিতরে ভিতরে একবারে গুমরে মরতে লাগলেন ইয়াসুকো। স্ত্রীর এই কষ্ট নিজের চোখে কি করেই বা দেখবেন কুরোকি? তাই তাঁর চেষ্টা জারি রইল ইয়াসুকোর মুখে এক চিলতে হাসি ফোটানোর।
এরমধ্যেই একদিন নিজের ফার্মে ঘুরতে ঘুরতে একটি দৃশ্য আবিষ্কার করলেন কুরোকি। তাঁর ফার্মের সৌন্দর্য বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ভীষণ যত্ন নিয়ে তিনি কতগুলি শিবাজাকুরা ফুল গাছ লাগিয়েছিলেন। গোলাপি সেই ফুলের টানেই আজ ছুটে এসেছে বেশ কিছু পর্যটক। ফুলগুলির সঙ্গে তারা ছবিও তুলছেন, করছেন নানা গল্পও। মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল কুরোকি। না-ই বা চোখে দেখতে পেলেন ইয়াসুকো, ফুলের সুবাস তো নিতেই পারবেন তিনি। কুরোকি তখনই স্থির করে ফেললেন আরও অনেক শিবাজাকুরার গাছ লাগাবেন বাগানে। গড়ে তুলবেন এক পর্যটন কেন্দ্র। যার টানে দেশ বিদেশ থেকে ছুটে আসবেন বহু মানুষ। তাদের উপস্থিতি হাসি ফোটাবে ইয়াসুকোর মুখে। তাদের গল্প শুনেই মন ভরাবেন তিনি। দেশ দেখার স্বপ্ন ঠিক এভাবেই পূরণ করবেন তিনি।
যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। দু বছর লাগল, কিন্তু ঠিকই গড়ে উঠল কুরোকির সেই বাগান। হাজার হাজার গোলাপি ফুলের সান্নিধ্যে তখন হেসে খেলে বেড়াচ্ছেন ইয়াসুকোও। সার্থক হল কুরোকির অক্লান্ত পরিশ্রম। বর্তমানে মার্চ-এপ্রিল মাসে শিবাজাকুরা ফোটার সময় বাগানে ঢল নামে হাজার হাজার মানুষের। ফুল বাগান এবং ইয়াসুকো, দুই-ই দেখার টানে ছুটে আসেন তাঁরা। কুরোকির দম্পতির প্রেমের বাগান তখন হয়ে ওঠে হাজার মানুষের মিলনক্ষেত্র। পর্যটকদের কাছে সে বাগান যে তখন হয়ে উঠেছে ভালোবাসার এক প্রতীক। স্ত্রীকে ভালোবেসে দেওয়া কুরোকির এই উপহারকে নতমস্তকে কু্র্নিশও জানান তারা। সত্যি! ইচ্ছে এবং জেদ তারসঙ্গে ভালোবাসার মিশেল! কত কি-ই না করতে পারে মানুষ। তোশিইউকি কুরোকি তারই প্রকৃত এক উদাহরণ।
Discussion about this post