হাওড়া জেলার পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা কতশত অজানা ইতিহাস। তার খোঁজ কজনই বা রেখেছি আমরা! এমন এক অসাধারণ কবি-সাহিত্যিক যার হাত ধরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য হয়েছে সমৃদ্ধ। তাঁর অসাধারণ লেখনী প্রতিভার দাপটেই তিনি পেয়েছিলেন মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবির তকমা। তিনি আর কেউ নন, অনেকের পরিচিত আবার অপরিচিতও বটে। তিনি হলেন হাওড়ার ভূরশুট পরগণার পেঁড়ো গ্রামের সন্তান ভারতচন্দ্র রায়। বাবা জমিদার হলেও সম্পত্তির ঝামেলার জেরে নিজের জায়গা ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় জীবন কাটাতে হয়েছিল তাঁকে। তবে জীবনের ছন্দ তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর অসাধারণ লেখনীর ছন্দেই। সেই লেখনীর গুণেই তাঁর জীবনের অন্যতম অসাধারণ এক কীর্তি দেবী অন্নপূর্ণার মাহাত্ম্যের কাব্য ‘অন্নদামঙ্গল’।
আগেই বলা হয়েছে যে তিনি ছিলেন জমিদার বাড়ির সন্তান। কিন্তু সেই জমিদারি ভাবনার আঁচটুকুও তাঁর গায়ে লাগার সুযোগ হয়নি। বরং সামান্য আশ্রয়ের জন্য তাঁকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, এককালে তাঁর কারাযন্ত্রণা ভােগ করা থেকে শুরু করে টাকা রোজগারের জন্য অন্যের দাসত্ব স্বীকারের মত ঘটনাও শোনা যায়। তবে তাঁর জীবনে মোড় ঘোরে কৃষ্ণনগরের রাজা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজদরবারে সভাকবি হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর। তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও কাব্যপ্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে রাজা তাঁকে ‘গুণাকর'(গুণের আকর) উপাধি দিয়েছিলেন। সেই থেকেই তিনি পরিচিত হতে থাকেন ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর নামে। মহারাজের আদেশেই তিনি রাজার কুলদেবতা অন্নদার মায়ের স্মরণে রচনা করেন অন্নদামঙ্গল কাব্যটি।
এই কাব্যটিতে শুধু দেবী অন্নপূর্ণার মহিমা নয়, পাশাপাশি কাব্যটিতে রয়েছে বিদ্যাসুন্দরের কাহিনী এবং মহারাজের পরিবারের একটি কাহিনী। মূলত তিনটি খন্ডে বিভক্ত ছিল কাব্যটি – অন্নপূর্ণা মঙ্গল, বিদ্যাসুন্দর এবং মানসিংহ। দেবী অন্নপূর্ণা ছিলেন লৌকিক চণ্ডী; পুরাণে আলোচিত চণ্ডীর প্রভাবে তিনি কীভাবে অন্নদায় পরিণত হয়েছেন এবং কীভাবে নিষ্ঠুর শক্তিদেবী থেকে শুভঙ্করী হয়ে উঠেছেন সেই কাহিনী কবি ভারতচন্দ্র খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তার দক্ষতায়। কাব্যটির প্রধান চরিত্রের নাম ঈশ্বর পাটনী। কাব্যের মাধ্যমে তার মুখে যে প্রার্থনাটি শোনা যায় তা প্রত্যেক বাবা – মায়ের চিরকালীন প্রার্থনা – “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।”এছাড়াও বেশ কিছু প্রবাদের উল্লেখ আমরা পাই যা আমরা রোজকারের কথাবার্তায় ব্যবহার করে থাকি, যেমন – ”জন্মভূমি জননী স্বর্গের চেয়ে গরিয়সী”,”নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়?”
কাব্যটির নানা প্রসঙ্গে কবি উল্লেখ করেছেন নবাব আলীবর্দী খাঁর শাসনামলে দেশে বর্গীর হাঙ্গামা, বিদেশি বণিকদের চক্রান্ত, সমাজের স্বার্থপরতা, দুর্নীতি প্রভৃতি নানা অবক্ষয়। পুরো কাব্যটি নীলমণি দেশাই নামে এক ব্যক্তি সঙ্গীতের আকারে রাজসভায় গেয়ে শুনিয়েছিলেন। রাজা এবং তাঁর সদস্যরা কবির ছন্দ-অলঙ্কারে মুগ্ধ হন। তাই মহারাজ এই সভাকবিকে জমি দান করেন যেখানে আমৃত্যু ভারতচন্দ্র বাস করেছিলেন। সেযুগের অন্যান্য মঙ্গলকাব্যগুলি যেখানে দেবদেবীর স্বপ্নাদেশেই রচিত হয়েছিল সেখানে এই অন্নদামঙ্গল কাব্য কিন্তু রচিত হয়েছিল মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশেই। তাই সব মিলিয়ে বাংলা ভাষা সাহিত্যের ইতিহাসে এই কাব্য আমাদের মাঝে এক আকর কাব্য হয়ে থাকবে প্রতিটি বাঙালির মননে।
Discussion about this post