কলকাতা পুকুরের শহর। কলকাতার পথ চলা মানে কখনও এক পুকুর থেকে আরেক পুকুরে ভেসে চলা। “জানালার নীচেই একটি ঘাট বাঁধানো পুকুর ছিল। তাহার পূর্বে ধারের প্রাচীরের গায়ে প্রকাণ্ড একটা চীনা বট, দক্ষিণ ধারে নারিকেল শ্রেণী। গন্ডী- বন্ধনের বন্দী আমি জানালার খড়খড়ি খুলিয়া প্রায় সমস্তদিন সেই পুকুরটাকে একখান ছবির বহির মতো দেখিয়া কাটাইয়া দিতাম।” রবি ঠাকুরের সেই গাছ আর পুকুর আর নাই। কিন্তু পুরনো কলকাতার পুকুরের ইতিহাসের দিকে যদি তাকানো যায় তবে তা খুবই আকর্ষণীয়।
ইংরেজেরা যখন কলকাতায় পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু করল, তখন স্থানীয় শেঠ, বসাক সাবর্ণ চৌধুরীদের ব্যবসার জায়গায় টলটলে জলের লাল দিঘি ছিল। পরে ইংরেজরা তার নামকরণ করে ‘গ্রেট ট্যাঙ্ক।’ লাল দীঘি কেন নাম ছিল তার পিছনে কারণ হিসাবে উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। যে বিখ্যাত ব্যবসায়ী লালচাঁদ বসাক এই দিঘি খনন করেন, তাই তার নাম অনুসারেই এর নামকরণ হয়। অন্য আরেকটি ব্যাখ্যায় পাওয়া যায়, পুকুরের পাশেই শ্যাম রায়ের মন্দিরে দোলযাত্রায় খুব ধুম করে উদযাপন হত। তার ফলশ্রুতিতে আবিরের রঙে দীঘির জল লাল হয়ে উঠত- তাই নাম লাল দীঘি। কলকাতা পুরসভার সীমানায় সবচেয়ে প্রাচীন জলাশয় রয়েছে সেন দীঘি, যা বোড়ালে অবস্থিত। এখানে মাটির তলায় পাল এবং সেন বংশের বিভিন্ন নমুনা পাওয়া গিয়েছে। আরও একটা প্রাচীন দীঘি রয়েছে বেহালা সরশুনায়। এটি চারশো বছরের পুরনো রায় দীঘি। যশোর অধিপতি প্রতাপাদিত্য রায়ের কাকা বসন্ত রায় সরশুনায় নিজের কাজের সদর দপ্তর করেন। আর নাম দেন রায়গড়। সেখানেই এই দীঘি।
দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের কাছে রয়েছে সাড়ে তিনশো বছরের পাগলা পীরের পুকুর। পীরের নাম হজরত মুকসুদ গাজি। পুকুরটা নিয়ে একটা গল্প আছে যে সেটি এক বুড়ির শশার ক্ষেত ছিল। পীর সাহেব সেই ক্ষেতের শশা চাইলে বুড়ি তা দেয় নি। তাই পীরের কথায় সেই ক্ষেত পুকুর হয়ে যায়। এই পুকুরের জল নিয়েও নানা লোক প্রচারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। এভাবেই গোটা তিলোত্তমা জুড়েই রয়েছে নানা পুকুর আর দীঘি। আর রয়েছে তাদের ঘিরে নানা ইতিহাস, লোক গাঁথা, গল্প।
আসলে আমাদের শহর কলকাতাকে একদিনে আবিষ্কার করা সম্ভব নয়। কলকাতা নিজেই ইতিহাসের আড়ালে এক রহস্য রূপে বার বার ধরা দেয় কলকাতা-প্রেমীদের কাছে। আমরা কলকাতা প্রেমীরা সেই রহস্যের রসে সুধা খুঁজি।
Discussion about this post