বৃষ্টির দিনগুলোতে মোটামুটি সব বাঙালির মনেই গরম ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ির দৃশ্য ভেসে ওঠে। পরিমান মতো ঘি এবং পছন্দসই ভাজাভুজি এর স্বাদ অমৃত করে তোলার জন্য যথেষ্ট। চালে ডালে মিশে তৈরি করা সাধারণ খিচুড়ির ইতিহাস এবং প্রকারভেদ কিন্তু বেশ আকর্ষণীয়। ইতিহাসবিদ মোহসিনা মুকাদমের কথায় “খিচুড়ি হল ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন খাবারের মধ্যে একটি।” তবে সময়ের সাথে সাথে সেভাবে খুব বেশি পরিবর্তন এর ঘটেনি।
‘খিচুড়ি’ শব্দটির উৎস হল সংস্কৃত শব্দ ‘খিক্কা’ থেকে যার অর্থ ভাত ও ডাল দিয়ে তৈরি খাবার বিশেষ। সপ্তদশ শতকে ভারতীয় জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষের প্রধান খাদ্য ছিল খিচুড়ি। বেশ কিছু ভারতে ভ্রমণ করা বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় খিচুড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন এক রাশিয়ান পর্যটক আফনাসি নিকিতেন ষোলোশ শতকে লিখেছিলেন যে ওই সময় খিচুড়ি মানুষ এবং খামারের পশু উভয়ের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ খাবার ছিল। আবার এক ফরাসি বণিকের লেখায় জানা যায় তিনি ভারতীয় সৈন্যদের খাদ্য হিসাবে খিচুড়ি খেতে দেখেছিলেন ঘি সহযোগে।
তবে খিচুড়ি যে কেবল সাধারণের খাবার ছিল তা কিন্তু মোটেই নয়। সম্রাট রাজাদের পছন্দের তালিকাতেও ছিল খিচুড়ির স্হান। তবে সেক্ষেত্রে খিচুড়ির ধরন একটু আলাদাই ছিল। যেমন সম্রাট আকবরের জন্য খিচুড়ি সমান পরিমাণ চাল ডাল ঘি এবং কিছু বিশেষ মশলা দিয়ে বানানো হতো। আবার সম্রাট জাহাঙ্গীর যেদিন মাংস খেতেন না সেদিন উনি খিচুড়ি খেতেই পছন্দ করতেন। তবে তার খিচুড়ি ‘লাজিজান’ নামে পরিচিত ছিল যার আবিষ্কার তিনি নিজেই করেছিলেন। এই রান্নায় তিনি বিশেষ কিছু মশলার সাথে শুকনো খাবার যোগ করতেন। ব্রিটিশ সম্রাটরাও এক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিলেন না। তারা আবার সেদ্ধ ডিম, মাছ ও ভাজা পেঁয়াজ দিয়ে খিচুড়ি খেতে ভালোবাসতেন।
এসব তো গেল পুরনো সময়ের কথা। আজকের দিনেও খিচুড়ির রকমভেদ শুনলে বেশ অবাক লাগবে। আমরা সাধারণত বাড়িতে বানানো খিচুড়ি নানা সব্জি ভাজা, মাছ বা ডিম ভাজা দিয়ে খেয়ে থাকি। আবার পূজোর ভোগের খিচুড়ির ক্ষেত্রে লাবরা ছ্যাঁচড়া সঙ্গে পায়েস দিয়েই খাই। তবে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যগুলিতে খিচুড়ি ভিন্ন স্বাদে পরিবেশিত হয়। যেমন তামিলনাড়ুতে ফসল কাটার সময় পোঙ্গল উৎসব পালিত হয়। যে খিচুড়ি তৈরি হয় এই সময় তাও পোঙ্গল নামেই পরিচিত। বেশ মশলাদার এবং মিষ্টি দুই স্বাদেই বানানো যায় পোঙ্গল। রয়েছে অন্ধ্রের কিমা খিচুড়ি। হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানির মতোই কিমা খিচুড়ি বিখ্যাত। সেক্ষেত্রে এর কৃতিত্ব অবশ্যই হায়দ্রাবাদি নিজামদের।
আবার আছে গুজরাটের গুজরাটি খিচুড়ি। খাঁটি ঘি দিয়ে তৈরি এই গুজরাটি খিচুড়ির স্বাদ সুলতান আহমেদ শাহের এতটাই ভালো লেগে যায় যে তিনি প্রায় দিনই এই খিচুড়ি খেতেন। চাল ডাল আদা মরিচ, কালো ছোলা, হিং এবং ঘি সহযোগে বানানো বিহারী খিচুড়ির স্বাদও অতুলনীয়। সাধারণত মকর সংক্রান্তি উদযাপনের সময় এই খিচুড়ি বানানো হয়। আবার উত্তর ভারতে বাজরা খুব জনপ্রিয় হওয়ায় চাল ডাল ও বাজরা দিয়েই বানানো হয় রাজস্হানী বাজরার খিচুড়ি। সেই স্বাদও ভোলার নয়।
Discussion about this post