কলকাতার পুজো হল এই শহরের অভিব্যক্তি। এই শহরের আবেগ। এই শহরের আভিজাত্য। বাঙালির বারোমাসের তেরো পার্বণ। সেখানে মূর্তি পুজোর চিন্তন খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের বঙ্গ জীবনে জড়িয়ে থাকে। কলকাতা শহরে বড়িষার সাবর্ণ চৌধুরী পরিবারই ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে আটচালা মন্ডপে প্রথম দুর্গা পুজো প্রচলন করে। যদিও প্রতিমা শিল্প কলকাতার অন্যতম লোকশিল্প। এই শিল্পে হাজার হাজার মানুষ জড়িয়ে আছেন। মন্ডপের আলোকসজ্জা ও জাঁকজমকের আড়ালে প্রতিমা শিল্পীদের মুখগুলো প্রায় হারিয়েই যায়। এমনই একজন শিল্পী হলেন মোহন বাঁশি রুদ্রপাল। ১৯৪৮ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। কুমোরটুলি এলাকাতেই তাঁর বাসস্থান। কুমোরটুলির পুরনো সরু আঁকা বাঁকা কারখানা ঘরেই তৈরি হয় মাটি আর রংতুলির সিম্ফনি। মোহন বাঁশি রুদ্র পালের বড় একটা স্টুডিও আছে উল্টোডাঙায়। তাঁর নিজেস্ব স্টাইলে প্রতিমার রূপ দান করেন। প্রতিমার কপাল তুলনামূলকভাবে চওড়া আর নাক তীক্ষ্ণ আর ছোট। ঠোঁট ভরাট ও বড়। চোখ দীঘল, চোখের মণি বড় ও ভরাট। এটাই তাঁর নিজস্বতার স্বাক্ষর।
আরেক বিশিষ্ট প্রতিমা শিল্পী হলেন সুধীর রুদ্র পাল। তাঁর পরিবার ১৯৪৭ সালে চৈত্র মাসে ঢাকা বিক্রমপুর থেকে কলকাতায় চলে আসেন।পটুয়া পাড়ায় তার বড় কর্মকান্ড রয়েছে। ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজের ভাস্কর্যের প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন সুধীর রুদ্র পাল। নৈহাটি থেকে সারা সপ্তাহ পটুয়া পাড়ায় ছুটে এসে কাজ করেছেন। আসলে বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িয়ে রয়েছে প্রতিমা শিল্প। সে শুধু দুর্গা মূর্তি নয়। কালী, সরস্বতী, লক্ষ্মী, শিব, গণেশ সব পুজোর আচারের সঙ্গেই রয়েছে মূর্তির গড়ার ঐতিহ্য। সেখানে আজও এই শিল্পীরা সত্যিই কি সম্মান পান? অর্থনৈতিক সঙ্কট, কাঁচা মালের দামের ওঠা নামা সবই এই শিল্পকে প্রভাবিত করে।
কুমারটুলি পাড়ার আরেক অন্যতম শিল্পী হলেন শক্তি কর্মকার। শোলার তৈরী সিংহবাহিনী দুর্গাও বানিয়েছেন। যা বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। শোনা যায় ১৯৬০ সাল থেকে আশির মাঝামাঝি পর্যন্ত দুই তিনটে সমান্তরাল ধারা চলেছিল, তার মধ্যে মাটির জটা বাঘ ছাল আর মাটির গয়নার ধারা চলল। তার প্রবর্তক হলেন নারায়ণ চক্রবর্তী। তারপর ১৯৭২ -৭৩ থেকে ১৯৮৪-৮৫ পর্যন্ত বাঙালি বধূ রূপে এলো চুল আর সাদা শাড়ি পরা ঠাকুর গড়ার প্রবণতা ছিল। যার প্রবর্তক আরেক শিল্পী গোরাচাঁদ পাল।তার ঠিক পনেরো বছর পর সোনার সালঙ্কারা মূর্তি নির্মাণ করে মোহন বাঁশি রুদ্র পাল আবার চোখে তাক লাগিয়ে দেন বাঙালির। শিল্পী রাধারমণ পালের কাজের জায়গা রয়েছে রামগড়ে। তিনি আর তাঁর সহকারী গুণ সিন্ধু হালদার কাঠামো থেকে আরম্ভ করে মাটির প্রলেপ, হাত, পা, বাহন সব গড়ে ছেড়ে দেন। তারপর অপর শিল্পী গোপাল পাল তার লোকজন বাকি কাজ করে। শিল্পী গোপেশ্বর পাল প্রথম ঠাকুরদের চাল আলাদা করে ছিলেন তিন দশকের শেষে। গত পঁচিশ বছরে অলক সেন বিশেষ ভাবে খ্যাতি অর্জন করেন। গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের ছাত্র তিনি। বাস্তব স্টাইল বজায় রেখে মূর্তি গড়েন। রাখাল পাল আবার শিবহীন নতুন ধারার চালচিত্রের সংযোজক এনেছেন। অর্ধবৃত্তাকার সমান্তরাল রেখা দুইয়ের মাঝে ঘন নীল রঙ, গোলাপি পদ্মফুল আর কলা পাতা রঙের আধখোলা পদ্মপাতা। এখানে শিব পার্বতীর সংসারের ছবি নেই, পরিপূর্ণ নিসর্গ শোভার মাঝে প্রতিমা।
আসলে সময়ের তালে তাল মিলিয়ে শিল্প চিন্তার বহিঃপ্রকাশে পরিবর্তন এসেছে। সেটাই প্রতিমা শিল্পের সৌন্দর্যের উপস্থাপনা। এভাবে বহু মানুষই প্রতিমা গড়ার শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। শুধু প্রতিমা তৈরীর শিল্পী নয় এই বৃহৎ কর্মকান্ডের সঙ্গে ডোকরা, শোলা, জরি, চুমকি সব ধরনের কাজের কারিগররাই জুড়ে থাকেন। কিন্তু পরিবেশ আর আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি বারেবারেই শিল্পীদের কাজের উপর প্রভাব ফেলে। যেমন এখন নিউ নর্মালে স্বাভাবিক সাধারণ মূর্তির চাহিদা রয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে প্রতিমা বায়নার হার কমেছে। আশা করা যায় সামনের কয়েক বছর পর অবস্থার কিছুটা হলেও উন্নতি হবে।
চিত্র ঋণ – সৌগত সিংহ, সমীর দত্ত এবং বুনো মাধব
Discussion about this post