বাঙালির আড্ডা জগৎ বিখ্যাত। আর আড্ডা দেওয়ার জন্য বাঙালির হরে-দরে উপকরণ লাগে তিনটি—চা, সিগারেট, ‘বিস্কুট’। কথা বলতে বলতে দুধ চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে ডুবিয়ে খাচ্ছেন আর চা শেষ করে চামচে করে তুলে নিতে হচ্ছে ভেজা ন্যাতনো এক টুকরো মারী বা বলা ভালো ব্রিটানিয়া মারী। ইংরেজদের আমরা বিদেয় দিয়েছি ঠিকই তবে এক পেয়ালা চায়ের সঙ্গে খাঁটি ইংরেজ মারী আজও বাঙালির প্রতিদিনের সঙ্গী। তবে বার বার শুধু বাঙালি বলছি কেন, মারী বিস্কুট তো সারা ভারতের লোকই সকাল বিকেল দিব্যি হজম করছে। বলছি কারণ বাঙালির সঙ্গে এনার সম্পর্ক যেমন পুরনো তেমনি রসের।
১৮৭৪ সালে প্রথম London Bakery Peek Freans এই মুচমুচে মিষ্টি মিষ্টি মারী বিস্কুট আবিষ্কার করে। রাশিয়ার ডাচেস মারিয়া অলেক্সনদ্রোভাঁর সঙ্গে এডিনবরার ডিউকের বিবাহ উপলক্ষ্যে লন্ডন বেকারি তৈরি করে এই অসামান্য বিস্কুটটি। তারপর আর কী, গোটা ইউরোপে শোরগোল ফেলে দিল এই গোলগাল মারী বিস্কুট। তবে শুধু স্বাদেই নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাজারে বিশেষত পর্তুগাল ও স্পেনের অর্থনৈতিক কাঠামোকে অনেকটা রক্ষা করেছিল এই মারী। এহেন মারী বিস্কুট সেই ব্রিটিশদের হাতে ধরে সোজা এসে ল্যান্ড করল কলকাতার মাটিতে। কারণটা সহজ, কলকাতাই ছিল তখন ভারতবর্ষের রাজধানী।
১৮৯২-সালে ২৯৫ টাকার পুঁজি দিয়ে একটি ব্রিটিশ কোম্পানি কলকাতায় প্রথম শুরু করে তাদের ‘ব্রিটানিয়া মারী বিস্কিটে’র ফ্যাক্টরি। নামের উৎপত্তি তো সহজেই অনুমেয়—ব্রিটেন থেকে হল ব্রিটানিয়া আর মারিয়া অলেক্সনদ্রোভাঁ থেকে মারী। ইংরেজরা অবিশ্যি খাঁটি ব্যবসাদার। তাই কি তারা প্রথম থেকেই বুঝেছিল যে বাঙালি এই বিস্কুট হরদম খাবে আর তাদের সাধের ‘বিস্কিট’কে করে দেবে ‘বিস্কুট’? একেবারেই না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে যথেষ্ট পরিমাণে বিস্কুট যোগান দেওয়াই ছিল ব্রিটিশ সরকারের মূল উদ্দেশ্য। সেই থেকে বাঙালির সঙ্গে রয়ে গেল রাশিয়ান মেমসাহেবের নামে নামাঙ্কিত ব্রিটানিয়া মারী।
তারপর অনেক জল বয়ে গেছে। নামে ব্রিটানিয়া হলেও এখন তা খাঁটি ভারতীয়। বর্তমানে অবিশ্যি আরো অনেকেই মারী বিস্কুট তৈরি করছে কিন্তু মারী বিস্কুট বলতেই আমাদের স্মৃতিতে যে সোনালী রঙের গোল গোল ছবিটা চকচক করে ওঠে সেটা একেবারেই ব্রিটানিয়া মারী। লক্ষ্য করেছেন নিশ্চই বিস্কুটটার ওপরে ব্রিটানিয়া শব্দটা যেন খোদাই করা। আসলে ঠিক এমনটাই করেছিল লন্ডন বেকারি রানী মারিয়ার বিবাহে। সেখানে অবশ্য শুধু মারী কথাটা এইভাবে লেখা ছিল। সেই রাজা রাণীর বিয়ে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর সেইখান থেকে আজ বাঙালির সকালে চায়ের সঙ্গে, স্কুলের টিফিনে, রকের আড্ডায় কোথাও বাদ নেই ব্রিটিশ কোম্পানির ব্রিটানিয়া মারী।
Discussion about this post