আমি নিজে সবজি বাজার করতে ভালবাসিনা, কিন্তু বাজারে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসি। কারণ বাজারে ঘুরে বেড়ালে, সুন্দর সুন্দর তরকারি, মাছ এসব দেখা যায়… আর শোনা যায় নানাধরণের কথোপকথন! ব্যবসায়ীদের Trade Cry তো আর মজাদার হয়! এরকম একদিন বাজারে ঘুরতে ঘুরতেই, চলে এসেছিলাম পাঁঠার মাংসের দোকানের কাছে। দূর থেকে দেখে লাইন মাপছিলাম! হঠাৎ চোখ পড়লো, একটু দূরে দাঁড়িয়ে, দুজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক ঝোলানো মাংস দেখছেন, আর নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় কিছু আলোচনা করেছেন। আমার খুব কৌতূহল হলো। ওদের পাশে মোবাইল দেখার অছিলাতে, দাঁড়িয়ে কথা শুনতে লাগলাম!
– “দেখতে দেখতেই বুড়ো হয়ে যাবো রে! ইচ্ছা থাকলেও কোনো উপায় নেই…”
– “কেন কি হয়েছে রে???”
– “আরে ওই ডাক্তারটা গত সপ্তাহে বলে দিয়েছে, Red meat is strictly NO. ব্যাটা নিজে ঠিকই সাঁটাচ্ছে, আর আমি খেলেই দোষ!”
– “যা বলেছিস! আমার তো বহুদিন আগেই পাঁঠা খাবার পাট চুকেবুকে গেছে! এখন কোথাও রান্না দেখলে, গন্ধ শুঁকে নিই। ওই একটা কথা আছে না?- “ঘ্রানেন অর্ধ্বং ভোজনায়অং!” ওদের কথা শুনে, আমি সরে এলাম। সত্যি একটা সময় ছিল, যখন মোটামুটি অনেক বাঙালি গেরস্থ বাড়িতে ছুটির দিন মানেই দুপুরে মিহি চালের ভাত, আর পাঁঠার মাংসের ঝোল! তখন এতো কোলেস্টরলের চোখরাঙানিও ছিল না! আর একমাত্র এই পাঁঠার মাংসকেই, আমাদের হিন্দুধর্মে নিরামিষ করে রান্না করার কথা বলা হয়েছে। পেঁয়াজ-রসুনবিহীন এই মাংসের ডাক নাম ‘নিরামিষ মাংস’। বাঙালি ছাড়া আমিষাশী ভারতীয়ের মধ্যে সম্ভবত, একটিমাত্র গোষ্ঠী কাশ্মীরি পণ্ডিতদের হেঁসেল-সংস্কৃতিই এমন নিরামিষ মাংস মাথায় করে রেখেছে। আর এই নিরামিষ মাংসকে তো সার্টিফিকেট দিয়েছেন স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু। পেঁয়াজ রসুনবিহীন সে মাংস ‘শুধু একটি-দু’টি নম্রভাষী তেজপাতা দিয়ে সুবাসিত, যার পাতলা টলটলে ঝোল কনসোমে-সূপের মতোই সুপেয়, মাংসের নিজ নির্যাসে কিরণবিন্দুচ্ছুরিত’।
তবে এখন যেমন আমাদের মাটন হলেই চলে যায়, এক কোপে কাটা হোক কি আড়াই পোঁচে, আগে কিন্তু তা একদমই ছিল না। আমি বলছি অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার কথা। দেবতার কাছে উৎসর্গ করা প্রাণী না হলে, সেকালের হিন্দুরা সেই প্রাণীর মাংস খেতেন না। সেগুলোকে বলা হতো ‘বৃথা মাংস’। কিন্তু বাঙালি তো চিরকালই ভোজনবিলাসী, তাই দিন দিন যখন পাঁঠার মাংসের চাহিদা বাড়তে লাগলো, তখন এই নিয়ম পালনের কড়াকড়ির খুব সমস্যা দেখা দিল। মূল সমস্যা ছিল দুটো; প্রথমত, প্রত্যেকের প্রয়োজনমতো অল্প পরিমাণে মাংস জোগাড় করা এবং দ্বিতীয়ত, ঘন ঘন বলি দেওয়ার জন্য আর্থিক ও লোকবলের অভাব। এই সমস্যার সমাধানের জন্য, কোলকাতাতে রাতারাতি গজিয়ে উঠলো অনেক কালীমন্দির লাগোয়া মাংসের দোকান, আর সেখানে কালিমূর্তিকে ধর্মের সাক্ষী হিসেবে রেখে, প্রসাদি পাঁঠার মাংস বিক্রি হতে লাগলো। অনেক জায়গাতে কালীর বদলে থাকতো পঞ্চানন্দ ঠাকুরের মূর্তি। এই সব কালীমূর্তিকে বলা হতো, কসাই কালী! বউবাজার আর চিৎপুর এলাকাতে এখনো এরকম মাংসের দোকানের কালী দেখা যায়। আর মাংসের দোকানের দেয়ালে, কালীমূর্তির ছবি তো আমি অনেক জায়গাতে দেখেছি ছোটবেলাতে। এই প্রসঙ্গে ‘সম্বাদ রসরাজ’ পত্রিকাতে ০৬.১১.১৮৪৯ তারিখে প্রকাশিত একটা বিজ্ঞাপনের উল্লেখ করবো:
মহাপ্রসাদ ছাগমাংস বিক্রীর বিজ্ঞাপন
সব্বসাধারণ হিন্দু মহাশয় গণকে নিবেদন করা যাইতেছে যাঁহারা মহাপ্রসাদ ছাগমাংস ব্যবহার করিয়া থাকেন তাহারা শ্রীশ্রীকালীঘাট ইত্যাদি স্থান হইতে মহাপ্রসাদ আনাইতে কষ্ট পাবে, এবং আনায়নকারি লোকেদের বেতন দিতে হয়, এবং পাতরেঘাটার শ্রীশ্রীকালীর নিকট হইতে অধিক মূল্যে অনেকে অল্প মাংস আনাইয়া থাকেন, অতএব আমি শোভাবাজার বালা খানা স্ট্রিটে শ্রীশ্রীমহামায়া শবশিবার বাটীতে মহাপ্রসাদ ছাগমাংস বিক্রয়ের এক আড্ডা করিলাম প্রত্যহ প্রাতঃকালে শ্রীশ্রীশবশিবার সাক্ষাতে বিধিপূর্বক ছাগ বলিদান হইবে তৎপরে সেই মাংস বিক্রয় করা আরম্ভ হইয়াছে, ধাম্মিক হিন্দু মহাশয়েরা আর বৃথামাংস আহার না করিয়া এই স্থান হইতে মাংস গ্রহণ করিবেন কিন্তু নগদ পয়সা ধার ধোর নাই।।
– শ্রীমকরন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়
কিন্তু এই নতুন পদ্ধতিতেও, ভাঙা-বেড়া দিয়ে ঢুকে পড়লো শেয়াল! শুরু হয়ে গেল বিপুল পরিমাণে ভেজাল মাংসের বিক্রি! হুতুমের ভাষায় যদি বলা হয়, “কালী ও পঞ্চানন্দ প্রসাদী পাঁঠার ভাগা দিয়ে বসেছেন, অনেক ভদ্রলোকের বাড়ী উঠনো বরাদ্দ করা আছে, কোথাও রসুই করা মাংসেরও সরবরাহ হয়, খদ্দের দলে মাতালবেনে ও বেশ্যাই বারোআনা। আজকাল পাঁঠা বড় দুষ্প্রাপ্য ও অগ্নিমূল্য হওয়ায় কোথাও কোথাও পাঁঠি পর্যন্ত বলি হয়, কোনো স্থলে পোসা বিড়াল ও কুক্কুটদের পর্য্যন্ত কেটে মাংসের ভাগায় মিশান দেওয়া হয়! যে মুখে বাজারের রসুই করা মাংস অক্লেশে চলে যায়, সেথায় বেড়াল কুকুর ফ্যালবার সামগ্রী নয়। জলচর ও খেচরের মধ্যে নৌকো ও ঘুড়ি, ও চতুস্পদের মধ্যে কেবল খাট খাওয়া নাই!”
তাহলে বুঝতে পারছেন তো, “ভাগাড় কান্ড” বহু পুরোনো ঘটনা! এইসব অরাজকতা আটকানোর জন্য, তৎকালীন সময়ে ইংরেজ সরকার ১৮৮৪ সালে এই ব্যবস্থা বন্ধ করে, বাধ্যতামূলকভাবে সরকারি কসাইখানাতে পশুহত্যার নির্দেশ দেয়। প্রথম কিছুদিন হিন্দুসমাজ এর বিরোধিতা করলেও, পরে মেনে নেয়। ওই যে পাঁঠার স্বাদ, সেটা থেকে ভোজনবিলাসী বাঙালি কতদিন আর বঞ্চিত থাকবে! S.W. Goode তাঁর ‘Municipal Calcutta’ বইতে লিখেছেন – “Calcutta at one time abounded in Kalisthans, i.e. places where goats’-meat was sold in the presence of an image of Kali, to show that the animal had been consecrated to the goddess before it was sacrificed. In 1877-88 memorials were submitted to the authorities, urging the suppression of these places, where slaughtering was carried on under insanity conditions, and flesh exposed in an unsightly manner.”
এবার বোঝা গেল যে, আমরা যে ‘বোকা পাঁঠা’ বলে গালি দিয়ে থাকি, সেটা একদম উচিত নয়! কারণ পাঁঠা ও পাঁঠার মাংসের ইতিহাস বহু পুরোনো! আমি তো ভাই আর কাউকে এই গালিটা দিতে পারবো না! অনেক মজা করে, অনেক গল্প বললাম, এবার আমার কথা ফুরনোর পালা। তবে শেষটা আমি একটু অন্যভাবে করতে চাই, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের একটা গল্পের অংশ দিয়ে। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের হাস্যকর, বস্তুত ঘৃণ্য রীতিনীতি এবং ভণ্ডামির উপর চমৎকার স্যাটায়ার লিখতেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, তাঁর ‘ডমরুচরিত’ ইত্যাদি অনেক গল্পে। একটি গল্পে তিনি একজন অত্যন্ত ধার্মিক নিষ্ঠাবান হেঁদু ব্রাহ্মণ ‘শ্রীল শ্রীযুক্ত গোলোক চক্রবর্তী’ মহাশয়ের পাঁঠা ব্যবসার মর্মস্পর্শী ছবি এঁকেছেন। ঠাকুরমশায়ের ব্যবসা হল পাঁঠার খোঁয়াড় চালানো, এবং ধর্মমতে পাঁঠা বলি দিয়ে তার ‘শাস্ত্রসম্মত’ মাংস নিষ্ঠাবান খাদকদের কাছে জোগান দেওয়া, আর চামড়া-টামড়া বিক্রি করে উপরি আয়।
“পাঁঠাকে ফেলিয়া ঠাকুর মহাশয় তাহাকে সেই খোঁটায় বাঁধিলেন। তাহার পর তাহার মুখদেশ নিজের পা দিয়া মাড়াইয়া জীয়ন্ত অবস্থাতেই মুণ্ডদিক হইতে ছাল ছাড়াইতে আরম্ভ করিলেন। পাঁঠার মুখ গুরুদেব মাড়াইয়া আছেন, সুতরাং সে চীৎকার করিয়া ডাকিতে পারিল না। কিন্তু তথাপি তাহার কণ্ঠ হইতে মাঝে মাঝে এরূপ বেদনাসূচক কাতরধ্বনি নির্গত হইতে লাগিল যে, তাহাতে আমার বুক যেন ফাটিয়া যাইতে লাগিল। তাহার পর তাহার চক্ষু দুইটি! আহা! আহা! সে চক্ষু দুইটির দুঃখ আক্ষেপ ও ভর্ৎসনাসূচক ভাব দেখিয়া আমি যেন জ্ঞান-গোচরশূন্য হইয়া পড়িলাম। সে চক্ষু দুইটির ভাব এখনও মনে হইলে আমার শরীর রোমাঞ্চ হইয়া উঠে। আমি আর থাকিতে পারিলাম না। আমি বলিয়া উঠিলাম— ‘ঠাকুর মহাশয়! ঠাকুর মহাশয়! করেন কি? উহার গলাটা প্রথমে কাটিয়া ফেলুন। প্রথম উহাকে বধ করিয়া তাহার পর উহার চর্ম্ম উত্তোলন করুন।’ ঠাকুর মহাশয় উত্তর করিলেন— ‘চুপ! চুপ! বাহিরের লোক শুনিতে পাইবে। জীয়ন্ত অবস্থায় ছাল ছাড়াইলে ঘোর যাতনায় ইহার শরীরের ভিতরে ভিতরে অল্প অল্প কাঁপিতে থাকে। ঘন ঘন কম্পনে ইহার চর্ম্মে একপ্রকার সরু সরু সুন্দর রেখা অঙ্কিত হইয়া যায়। এরূপ চর্ম্ম দুই আনা অধিক মূল্যে বিক্রীত হয়। প্রথম বধ করিয়া তাহার পর ছাল ছাড়াইলে সে চামড়া দুই আনা কম মূল্যে বিক্রীত হয়। জীয়ন্ত অবস্থায় পাঁঠার ছাল ছাড়াইলে আমার দুই আনা পয়সা লাভ হয়। ব্যবসা করিতে আসিয়াছি, বাবা! দয়ামায়া করিতে গেলে আর ব্যবসা চলে না।”
তথ্যসূত্র:
- হুতুম পেঁচার নকশা – কালীপ্রসন্ন সিংহ
- Municipal Calcutta – S. W. Goode
- ‘সম্বাদ রসরাজ’ পত্রিকা ৬ই নভেম্বর, ১৮৪৯
- ‘খাও পাঁঠা, বাজাও তালি’ – ঋজু বসু
- হিন্দু ধর্মে বলি প্রথার আদ্যোপান্ত – কৌস্তভ
Discussion about this post