মেহেরপুর জেলার আমঝুপি ইউনিয়নে কাজলা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে নীলকুঠি। ব্রিটিশ আমলের নীলচাষের এক বিরল নিদর্শন এটি। ঐতিহাসিকদের মতে, ১৮১৫ সালের পরপরই এ স্থাপনাটি নির্মিত হয়।তবে এর প্রেক্ষাপট তৈরি হয় ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির আইন প্রতিষ্ঠার পর। তখন বর্তমান মেহেরপুরসহ পুরো নদিয়া অঞ্চল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে আসে। কৃষকদের খাদ্যশস্য ছেড়ে নীলচাষে বাধ্য করা হতো। এক বিঘা জমিতে নীল উৎপাদনে খরচ হতো ১২ থেকে ১৪ টাকা, অথচ কৃষকরা পেত মাত্র তিন থেকে চার টাকা। এই বৈষম্য ও শোষণের ফলেই ১৮৫৯ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে ঘটে নীল বিদ্রোহ। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে নীলচাষের জোরপূর্বক নীতি বাতিল করে। এই ঘটনাগুলো নীলকুঠিকে বাংলার কৃষক শোষণ ও প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী করে তুলেছে।

নীলকুঠির স্থাপত্যশৈলীতে ইউরোপীয় ধাঁচ স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। পুরো কুঠিবাড়িটি ছিল প্রায় ৭৭ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। এটিতে ছিল ১৩টি ছোট-বড় কক্ষ, সামনে ও পেছনে বারান্দা, কাঠের দরজা-জানালা, লুভারযুক্ত প্যানেল, স্তম্ভসজ্জিত বারান্দা ও লোহার রেলিং। ভেতরে ছিল ফায়ার প্রেস বা অগ্নিকুণ্ড, যা শুধু তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখত না, সামাজিক সমাবেশ ও আলোচনারও কেন্দ্র ছিল। দেয়ালে টাঙানো বিশাল মহিষের মাথা ব্রিটিশ শিকার সংস্কৃতির নিদর্শন হিসেবে এখনও দেখা যায়। প্রাঙ্গণে রয়েছে একটি পায়রার ঘর, যা ডাক আদান-প্রদানের মাধ্যমে যোগাযোগের কাজে ব্যবহৃত হতো। প্রধান হলরুমে রাখা লাল ইটের অগ্নিকুণ্ড এবং দেয়ালে টাঙানো রবার্ট ক্লাইভের প্রতিকৃতি এই ভবনের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে বাড়িয়ে তোলে। যদিও ইতিহাসবিদরা উল্লেখ করেছেন যে ক্লাইভের উপস্থিতির দাবি ও পলাশীর যুদ্ধের সঙ্গে নীলকুঠির সম্পর্ক জনশ্রুতি মাত্র, কারণ ভবনটি নির্মিত হয়েছিল ১৭৫৭ সালের বহু পরে।

স্থানটির চারপাশে রয়েছে শতবর্ষ পার করা বৃক্ষরাজি। প্রধান ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুটি বিশাল নীলগাছ, যেগুলো ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হিসেবে পরিচিত। এছাড়া আশেপাশে আম, লিচু ও শিরিষ গাছ স্থানটির পরিবেশকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। স্থানীয়দের মধ্যে প্রচলিত আছে, নিস্তব্ধ রাতে কৃষকদের কান্নার শব্দ ভেসে আসে, সেই শব্দ দুঃসহ সময়ের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। এসব লোককথা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত না হলেও মানুষের আবেগে নীলকুঠির স্থানকে গভীর করেছে। পাশের কাজলা নদীর ধারে থাকা সেতুটি ঔপনিবেশিক আমলের যাতায়াত ব্যবস্থার স্মারক হিসেবে চিহ্নিত। ফলে নীলকুঠি কেবল একটি স্থাপনা নয়, বরং অতীত জীবনের নানা স্তরকে ধারণ করা একটি ঐতিহাসিক আর্কাইভ।

বর্তমানে নীলকুঠি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে সংরক্ষিত। ২০১৭ সালে মূল ভবন সংস্কার করে একটি জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে। তবে পুরো ৭৭ একরের মধ্যে মাত্র ৩.৬১ একর সরকারি নিয়ন্ত্রণে আছে। অবশিষ্ট অংশ দখল ও অব্যবস্থাপনার কারণে ঝুঁকির মুখে রয়েছে। ছাদের ফাটল, দেয়ালে লতাগুল্মের বিস্তার এবং দীর্ঘ অবহেলার কারণে ভবনটি ক্রমশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন দখলমুক্তকরণ ও পুনর্নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, যদিও এর বাস্তবায়ন এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। ইতিহাসবিদরা সতর্ক করেছেন, যথাযথ সংরক্ষণ ছাড়া এই ঐতিহাসিক স্থাপনা বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই আমঝুপি নীলকুঠি শুধু কৃষক শোষণ ও প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবেই নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঔপনিবেশিক ইতিহাস জানার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য একটি অপরিহার্য ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন।

Discussion about this post