শতাব্দী প্রাচীন কল্লোলিনী তিলোত্তমা কলকাতা আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো শহরগুলির মধ্যে একটি। ‘সিটি অফ জয়’ নামে খ্যাত এই শহরকে কেন্দ্র করে জড়িয়ে রয়েছে কতশত স্মৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য। ভিক্টোরিয়া, হাওড়া ব্রিজ থেকে শুরু করে ট্রাম, হলুদ ট্যাক্সি বা রসগোল্লা কি নেই সেই তালিকায়! আধুনিকতা আর বনেদিয়ানার দুষ্প্রাপ্য সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে এই শহর। গত কয়েক বছরে এর বিভিন্ন কিছুর বদল ঘটেছে, প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে শহর জুড়ে। তবু এর মধ্যেই সমান তালে বেঁচে আছে কলকাতার স্মৃতি এবং ঐতিহ্যরা। অবশ্য আরেকটা জিনিসও এই ঐতিহ্যের ভাগীদার সমান ভাবেই, তা হল হাতে টানা রিকশা।
![](https://dailynewsreel.in/wp-content/uploads/2020/04/Handpulled_Rikshaw_of_Kolkata-1024x768.jpg)
উত্তর কলকাতার অলি-গলি অথবা শহরের রাজপথে আজও চোখে পড়ে এই হাতে টানা রিকশা। সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি এই রিকশা চালক পায়ে হেঁটে কোনো যাত্রীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, কানে বেজে চলেছে ঠুং ঠুং আওয়াজ। এই রিকশা চাকা কাঠের তৈরি যা আকারে বড়ো এবং মোটা। পা রাখার জায়গা থেকে যুক্ত থাকে রিকশা টেনে নেওয়ার হাতল। রিকশা বসার জায়গাটি বানানো হয় লোহা দিয়ে। যাত্রীদের বসার সুবিধার জন্য খড়ের আরামদায়ক গদি দিয়ে মোড়া থাকে সেটি। রোদ-বৃষ্টি থেকে যাত্রীকে রক্ষা করার জন্য থাকে ছাউনিও থাকে সেখানে।
টানা রিকশা সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয় জাপানে। এরপর ১৮৮০ সালের সিমলায় চীনা ব্যবসায়ীদের হাত ধরে ভারতে প্রথম চালু হয় এই রিকশা। সেখান থেকেই ১৯১৪ সালে প্রথম ভাড়াটে রিকশার চলতে শুরু করে মহানগরীর বুকে। সেই থেকে ঐতিহ্যবাহী এই রিকশা এখনও সমানতালে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কলকাতার রাস্তা। ঐতিহ্যের এই বাহন বিভিন্ন সিনেমাতেও নিজের স্থান করে নিয়েছিল। বিমল রায়ের ‘দো-বিঘা জামিন’ সিনেমায় দেখা গিয়েছে গ্রামীণ এক কৃষকের কাজের সন্ধানে কলকাতায় আসা এবং তারপর এই রিকশাকে জীবিকা বানানোর গল্প। অন্য আরেকটি সিনেমা ‘সিটি অফ জয়’তেও এই রিকশার দেখা মিলেছে।
![](https://dailynewsreel.in/wp-content/uploads/2020/04/dfhd-1024x701.jpg)
শহরের পার্ক স্ট্রিট, নিউমার্কেট এলাকা, কলেজ স্ট্রীট সহ বিভিন্ন জায়গাতেই এই একটুকরো ঐতিহ্য খুঁজে পাবেন। নিউ মার্কেটের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে সারি সারি হাত-টানা রিকশা, যাত্রীর জন্য অপেক্ষারত। তাদেরই একজন শ্যামল দাস। ঠুং ঠুং ঘণ্টা বাজিয়ে চলেছেন। যাত্রীদের নজর কাড়তে এ ঘণ্টা বাজানো হয় বলে জানান তিনি। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, রিক্সার অধিকাংশ চালকই বয়সে প্রবীণ। রিক্সা চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ পেশা যেমন কষ্টদায়ক তেমনি কম লাভজনক। তাই নবীনরা আর এ পেশায় আসতে চান না। তাই ইদানিং প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার অপেক্ষায় ধুঁকছে তিলোত্তমার এই নস্টালজিয়া। রামলীলা ময়দানের উল্টো দিকে পরপর তিনটে গলি। এই গলিতেই থাকেন নন্দকুমার শর্মা। তাঁর পেশা ঘোড়ার গাড়ি এবং হাতে টানা রিকশার চাকা সারানো। এই শহরে হাতে টানা রিকশার চাকা সারাতে জানেন একমাত্র নন্দকুমারই। আগে এই পেশায় অনেকেই ছিলেন। রোজগার সেরকম হয় না বলে সকলেই ধীরে ধীরে সরে গিয়েছেন। নন্দকুমার অবশ্য এখনও আঁকড়ে রয়েছেন পেশা। বয়স এবং দারিদ্র্যর সঙ্গে লড়াই করেই জীবন সংগ্রাম চলছে তাঁরও।
বর্তমানে আধুনিক গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই রিকশা আর কতদিন টিকবে তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। সময়ের সঙ্গে নতুন প্রজন্ম আসবে, তার সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে একসময় হয়তো হারিয়েই যাবে কলকাতার এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। তবে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে হাতে টানা রিকশার সংগ্রামের কাহিনী।
Feature Image Credit – Jiyavorali Sen
Discussion about this post