এক দশক আগেও আপনি ছিলেন শান্তশিষ্ট, লক্ষ্মীমন্ত? ‘এক দশক পর’ কি ‘ঘেঁটে যাচ্ছে’ সব কিছু? তাহলে আর দেরি কেন মশাই? হোন না একটু ‘লক্ষ্মীছাড়া’। ‘এক দশক পর’ দিন বদলের গল্প নিয়ে ডেইলি নিউজ রিলের সঙ্গে আলাপচারিতায় ছিলেন গৌরব গাবু চ্যাটার্জী। চলুন তবে সাক্ষী থাকুন সেই মুহূর্ত যাপনের।
লক্ষ্মীছাড়ার মধ্যে মহীনের ঘোড়াগুলি কতটা “আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি”?
‘লক্ষ্মীছাড়া’ নামটাই আমার বাবা গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের দেওয়া। আমাদের শুরুই হচ্ছে, ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র সম্পাদিত, বাংলা ব্যান্ডের গানের প্রথম অ্যালবাম ‘আবার বছর কুড়ি পরে’ দিয়ে। আবারও এখন তাই ‘এক দশক পর’ ঠিক যেমন শুরুটা হয়েছিল। অবশ্যই একটা সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে, উল্লিখিতভাবে গৌতম চট্টোপাধ্যায়, ওনার কাজ এবং মহীনের গানের প্রভাব আমাদের ওপর সরাসরি রয়েছে। যদিও ‘লক্ষ্মীছাড়া’ ব্যান্ডের মিউজিক ডিরেকশন অনেক বেশি রক। ‘লক্ষ্মীছাড়া একটা এসেন্সিয়াল রক ব্যান্ড, আমরা কাজটা সেভাবেই করেছি। কিন্তু শুরুটা ওখান থেকেই। ঠিক যেমন জেনেটিক সম্পর্ক হয় ঠিক তেমনই গৌতম চট্টোপাধ্যায়, ওনার কাজ এবং মহীনের ঘোড়াগুলির বাংলা গানের প্রভাব আমাদের ওপর সরাসরি রয়েছে।
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো, যা আমাদের ভাবাচ্ছে, পোড়াচ্ছে বা আলোকিত করছে, আদৌ কি সেসব লক্ষ্মীছাড়া’র গানে ছাপ ফেলতে পেরেছে?
কোনও একটি মাত্র ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমরা কাজ করি না। আমরা বিষয়টা আরও বৃহত্তর স্বার্থে ভাবি। চারিদিকে যে এতো ফ্যাসিজম চলছে, সব কিছুতেই যেন এক উদযাপন চলছে, আমরা সেই নিয়ে ভাবি। ট্রেন্ডে গা ভাসানো আমাদের স্টাইল নয়, আমরা ওভাবে কাজ করি না। আমাদের ‘এক দশক পর’ অ্যালবামের গানগুলো শুনলেই মানুষ বুঝতে পারবে চারটে গানের মধ্যে তিনটে গানই দিন বদলের কথা বলে। প্রতিদিন যা ঘটে চলেছে তা পরিবর্তনের কথা বলে। শুধু শেষ গানটায় আমরা জীবন থেকে কতটা কৃতজ্ঞ সেই কথাই বলা আছে।
আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগে বাংলা মৌলিক গানের ভবিষ্যৎ কতটা উজ্জ্বল?
পরিবর্তনটা সব সময়ই হতে দেখা যায়। খুব সহজ উদাহরণ দিয়ে যদি বলি, তাহলে বলবো লক্ষ্মীছাড়া ব্যান্ড যখন তাদের প্রথম অ্যালবাম বের করে, সেটা সিডিতে বের করে, ক্যাসেটের যুগ তখন শেষ। তখন স্পটিফাই ছিল না, আর আজ সবটাই ডিজিটাল হচ্ছে। আজকের যুগে দাড়িয়ে আমরা একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলি, অথচ আমাদের সম সাময়িক বা জুনিয়র যারা আছে তারা অনেক আগেই সেটা খুলে ফেলেছে। এই ক্ষেত্রে আমরা অনেকটা দেরি করেছি। আমার বক্তব্য হচ্ছে, সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে যা যা কিছু নতুন হচ্ছে, সেটাকে সাথে নিয়ে, সেটার সঠিক ব্যবহার করে চলাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটা নতুন সব কিছুর ক্ষেত্রেই খাটে। বাংলা গানের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। আগে যেমন কোনো গান বা কিছু বেরোলে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের রেডিও, টিভির একটা সাপোর্ট থাকতো। যদিও সেটার সাথে যুগের কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু সেটা এখন একেবারেই পাওয়া যায় না। কাজেই যে যার নিজের মতো করে সেটা করছে। তাই আমার মতে যখন যা পরিস্থিতি, যখন যা নতুন, সেটাকে ধারণ করেই চলতে হবে, অনেকেই চলেছে এবং চলছে। তবে আমার মনে হয় শ্রোতারা তাদের দায়িত্ব পালন করলে সব কিছুই উজ্জ্বল।
সফল বাংলা ব্যান্ড হতে গেলে কি শুধু টিম ওয়ার্ক, প্রতিভা আর জনসংযোগই যথেষ্ট?
অবশ্যই এগুলো তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমার মনে হয় খাটনি, প্রতিভা, যা কিছু আছে একটা টিমওয়ার্কের মধ্যে, এক সাথে কাজ করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার মনে হয় এখন এই নতুন সময় কী কী ভাবে মানুষের কাছে গানটা পৌঁছয় সেটা নিয়ে ভাবনাটা খুব দরকারী। তার জন্য অবশ্যই খুব ভালো গান হতে হবে, কি খুব ভালো বাজাতে জানতে হবে, কি ভালো সুর হতে হবে, সেই ভালো খারাপের গভীরে যাচ্ছি না। তবে নিজেরা নিজেদের কাজে বেস্টটা দিতে পারছে কিনা বা সেটা নিয়ে ভাবতে পারছে কিনা, সেটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ। তার পাশাপাশি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কিছু মেইনস্ট্রিম মিডিয়াগুলো যখন সাপোর্ট দেয় না, সেই অবস্থায় অল্টারনেটিভ ভাবে কী করে মানুষের কাছে পৌঁছনো যায়, সেটা ভাবনাটাও প্রয়োজনীয়। কারণ নব্বই দশক থেকে দু’হাজার দশ পর্যন্ত এই ট্রেন্ডটা ছিল, যখন টেলিভিশন রেডিওগুলো বাংলা ব্যান্ড নিয়ে প্রচুর কাজ করতো। ওই ব্যাপারটা তো এখন একেবারেই নেই। তাই অল্টারনেটিভ ভাবে এগিয়ে যাওয়াটা খুব দরকার। গান শুনে কে কি বললো সেটা ভেবে অবসাদ না এনে নিজের ওপর বিশ্বাস রেখে এগিয়ে যাওয়া দরকার।
হাওয়ায় কান পাতলেই বাংলা ব্যান্ডকে ঘিরে নানান পলিটিক্সের কথা শোনা যায়, বাস্তবে তার রূপ কেমন?
আমার মনে হয় বর্তমান যা পরিস্থিতি, তাতে পলিটিক্সের চেয়ে মানুষ একসাথে কাজ করতে বেশি পছন্দ করে। হ্যাঁ, তবে এটাও বুঝতে হবে যে আমাদের সমসাময়িক সবারই বয়স হয়েছে। কম বয়সে সবারই একটা কম্পিটিশনের ধুম থাকে। আর শুধু কম বয়স কেন মঞ্চে উঠলে একটা কম্পিটিশন তো থাকেই। তবে আমি যেটা মনে করি, স্টেজে দশটা ব্যান্ড উঠলে দশ জনই যদি ফাটিয়ে দেয় তাহলে তো কোনো চাপ নেই। কাউকেই হারতে হবে না, এটা তো আর ক্রিকেট বা ফুটবল ম্যাচ নয় যে হার জিতের ব্যাপার থাকবে। মঞ্চে যদি একাধিক ব্যান্ড ওঠে, সবাই ভালো বাজবে, সবাইকে নিয়েই ক্রাউড খুশি থাকলে, সবারই জয় সেটা। তবে মজার বিষয় হলো, কুড়ি বছর আগে ব্যান্ডের ফলোয়ারদের মধ্যে মারপিট করতে দেখেছি। “তুমি লক্ষ্মীছাড়া ব্যান্ডের? আমি ক্যাকটাস” ব্যান্ডের? চলো মারপিট করি!” (সহাস্যে) খুব অদ্ভুত একটা ব্যাপার! আর পলিটিক্সটা হলো এমন একটা জিনিস, যেটা মানুষের ওপরে নির্ভর করে। মানুষ হিসেবে তুমি কেমন? সে তুমি ব্যান্ড করো অথবা কোনো কোম্পানিতে চাকরি করো। এখন বিভিন্ন ব্যান্ডগুলো কোলাবোরেশন কাজ করতে, এক সাথে সময় কাটাতে বেশি ভালোবাসে। আর পলিটিক্সের ব্যাপার যদি কিছু থেকেও থাকে, সেটা আগের থেকে অনেক কম।
ভিডিও ইন্টারভিউটি দেখার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন
লক্ষ্মীছাড়ার নতুন অ্যালবাম ‘এক দশক পর’ বর্তমান দশকের প্রজন্মকে কতটা ছুঁতে পারল?
‘এক দশক পর’ অ্যালবাম রিলিজ হওয়ার অনেক আগে থেকেই আমরা গানগুলো অন স্টেজে শো করেছি। কেমন রেসপন্স আসে সেটা দেখার জন্যই, তো সেখানে মানুষ কিন্তু গান শুনেছে এবং এনজয় করেছে। তারপর অ্যালবাম রিলিজ হওয়ার পর তো এখনও পর্যন্ত ৯০% পজিটিভ রেসপন্স। অ্যালবামের চারটে গান যেমন চার রকমের, আমি দেখেছি আলাদা আলাদা মানুষের আলাদা আলাদা গান প্রিয়। এটাও কিন্তু একটা ভালো লক্ষণ আমার চোখে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অ্যালবামের চারটে গানের মধ্যে একটা গান প্রিয় আর বাকিগুলো নয়, তার থেকে যদি চারটে গানের আলাদা আলাদা ফলোয়ার হয়, সেটাই আমার কাছে ভালো। একটা কথা আগেই বলেছি আমাদের ইউটিউব চ্যানেল ইত্যাদি, আমরা অনেক দেরিতে শুরু করেছি। তো সেখানে সাবস্ক্রাইবার বাড়াতে অবশ্যই অ্যালবামটা সাহায্য করছে। পাশাপাশি এটাও বুঝতে হবে যে আমাদের কোনো ফ্যান ক্লাব নেই, যেটা আমরা ডেডিকেটেড ভাবে করতে পারি। যেটার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে ফসিলস্। যেখানে ব্যান্ডের গানকে সেভাবে মেইনস্ট্রিম মিউজিক হিসেবে ধরা হয় না, সেখানে দাঁড়িয়ে একটা ফ্যান ক্লাব তৈরি করে, ব্যান্ড মিউজিকে একটা ম্যাসিভ লেভেলে নিয়ে যাওয়া, সত্যি একটা বিপ্লবের সমান। আমরা এই ফ্যানক্লাবটা করতে পারিনি কারণ আমরা সেভাবে টাইম দিতে পারিনি। সত্যি বলতে আমরা ব্যক্তিগত ভাবে অনেক কিছুই করতে পারিনি। সেরকম আমাদের কেউ নেই কাজটা করার। সেই জায়গা থেকে আমাদের গান যে মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে সেটাই আমার কাছে বিশাল বড়ো ব্যাপার। পুরনো গান, যুগে যুগে গেয়েছি, সেটা হলে আলাদা ব্যাপার হতো কিন্তু আমি দেখছি আমাদের নতুন গান মানুষ গাইছে, গানের লিরিক্স তাদের মুখস্থ, মাত্র দু’মাস হয়েছে মানুষ স্টেজের সামনে এসে তালে তালে গাইছে। এটাই বিশাল পাওয়া। তাই বলবো বেশ কিছু বছর অনেক গান রিলিজ হয়নি, ‘এক দশক পর’ হল আরও নতুন নতুন গান মুক্তির সূত্রপাত।
বর্তমানে রিয়ালিটি শো-গুলোর দাপটে বাংলা ব্যান্ডের গান কি কোনও ভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে?
বাংলা ব্যান্ড বা, আধুনিক গায়ক গায়িকা যাই বলি, ছবির বাইরে গান কিন্তু দু’হাজার দশের পর থেকে আস্তে আস্তে মেইনস্ট্রিমে আর নেই। অবশ্যই রেডিও, টিভি গান চালানো বন্ধ করে দিয়েছে। এখন গান চালাতে লক্ষ লক্ষ টাকা চায়, এগুলো আগে ছিল না। আমরা তো আর ছবির প্রোডিউসার নই। তাই ওইসব করে ওই চ্যাপ্টারটা চাপা পড়ে রয়েছে বহুদিন ধরেই। আমি বলতে চাইছি দু’হাজার দশের সময়টায় এটা ছিল। তার থেকে এখন অনেক বেটার কারণ এখন সোশ্যাল মিডিয়ার গুরুত্ব আরো অনেক বেশি। বা বলা ভালো সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আরো অনেক কিছু করা যায় যেটা হয়তো ওই লেভেলে তখন হত না। সেইখানে দাড়িয়ে আমি বলবো আমাদের কামব্যাক হচ্ছে এটা। আমরা একটা অ্যালবাম বের করলাম, ‘কায়া’ একটা করেছে, আরো বেশ কয়েকজন। এরকম একের পর এক অ্যালবাম বেরচ্ছে। এমনকি শোতে কিন্তু এখন আবার আগের মতো ভিড় হচ্ছে। সেটারও কিন্তু একটা বড় কারণ হচ্ছে মানুষ প্যান্ডেমিকে ঘরে বসে সারাক্ষণ ওটিটি ঘেঁটে ঘেঁটে বোর হয়ে গিয়েছে। তাই আমার মনে হচ্ছে যখন থেকে লকডাউন উঠে সব কিছু স্বাভাবিক হয়েছে, ক্রাউডটা কিন্তু আবার একটা ম্যাসিভ লেভেলে হচ্ছে। আর আমরা কিন্তু সো কল্ড মেইন স্ট্রিম নই, কিন্তু আমাদের গান যেভাবে মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে, তারা গান গাইছে, রিল করছে, স্টোরিতে দিচ্ছে, পেজে দিচ্ছে, আমি সিওর এখনও আমরা স্টেজে উঠলে এখনও মানুষ ভিড় করবে।
Discussion about this post