১৯৪৭-এর দেশ ভাগ ও তার পূর্ববর্তী সময়ে ভারতে দাঙ্গার পর বাংলাদেশের সৈয়দপুর শহরে প্রবল প্রতিপত্তি বিস্তার করে ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত অবাঙালি শরণার্থী। তারা স্থানীয় বাঙালিদের কাছে বিহারী নামে পরিচিত। ভিটেমাটি হারিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে চলে আসার বিষয়টি এরা সহজে মেনে নিতে পারেনি তাই মনে মনে ক্ষোভ পুষিয়ে রেখেছিল এদের কেউ কেউ। বাংলাদেশ যখন পূর্ব পাকিস্তান তখন সৈয়দপুরের বিহারীদের একটি অংশ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পা চাটা দালাল ছিল। ফলতঃ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এরা রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহনীর সক্রিয় সদস্য হিসেবে নাম লেখায়। বাংলার পরিবর্তে উর্দু কালচারকে প্রতিষ্ঠা করতে এদের তৎপরতা ছিল উল্লেখ করার মতো। উদাহরণস্বরূপ- সৈয়দপুরের পরিবর্তিত নাম দেয়া হয়েছিল ‘গাজীপুর’, গোলাহাট উপশহরের নাম ‘নিউ বিহারপুর’, বিমানবন্দরের নামকরণ করা হয়েছিল ‘জমজম বিমানবন্দর’।
বিহারিদের বিভিন্ন আহ্বান ও দাবির মধ্যে ছিল- মাওলানা সাব্বির ও মাওলানা ইসরাইল কর্তৃক বাঙালিদের উর্দুতে কথা বলার আহ্বান, সৈয়দপুর টেকনিক্যাল স্কুল ও সৈয়দপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে উর্দু মিডিয়াম চালু, প্রেক্ষাগৃহে বাংলা সিনেমা প্রদর্শনে বাধাদান ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণের পর স্থানীয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) ডা. জিকরুল হকের নেতৃত্বে সৈয়দপুর থানা ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি’ গড়ে ওঠায় বিক্ষুব্ধ বিহারীরা সংঘর্ষের পথ খুঁজতে থাকে। মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা জড়ানো জিপে এমএনএ আবদুর রউফ সৈয়দপুরে আসলে ক্ষুব্ধ অবাঙালি তরুণরা পতাকা ছিঁড়ে ফেলে এবং তাকে দৈহিকভাবে লাঞ্ছিত করে। ২৬ মার্চ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘোষণা আসার পর সৈয়দপুরের স্থানীয় রাজাকার, আলবদর, আল-শামস বাহিনী ধরে ধরে স্থানীয় বাঙালী হিন্দু ও মারোয়াড়ি হিন্দু সম্প্রদায়কে হত্যার পরিকল্পনা শুরু করে।
১৯৭১ সালে জুন মাসের দিকে স্থানীয় হিন্দু বাঙালি এবং মারোয়াড়ি হিন্দু সম্প্রদায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও বিহারিদের হাত থেকে বৃদ্ধ-মা-বাবা-স্ত্রী-শিশুর জীবন বাঁচাত ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। ১৩ জুন, ১৯৭১ স্থানীয় বাঙালী হিন্দু ও মারোয়াড়িরা সরল বিশ্বাসে ভারতে চলে যাওয়ার বিষয়টি প্রতিবেশী বিহারি রাজাকারদের কানে পৌঁছালে তারা ঠিক এভাবে আশ্বস্ত করে, “ভাইয়া, বেহেন জি, আপ বিলকুল মত শোচিয়ে, কুছি ওয়াক্ত পে আপ লোগো কো হাম মেহফুজ ভারত পে পৌঁছা দেঙ্গে।” এভাবেই সূচনা হয় চারশোর অধিক নিরীহ বাঙালি হিন্দু ও মারোয়াড়ি হত্যার কালো অধ্যায় অপারেশন ‘খরচা পাতা’।
কথা ছিল হিন্দু শরণার্থীদের নিয়ে চার বগির ট্রেনটি সৈয়দপুর রেলস্টেশন থেকে চিলাহাটি সীমান্ত হয়ে ভারতের জলপাইগুড়ি যাবে। ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষায় সময় যেন কাটছে না। একটি ক্ষণ যেন একটি যুগের সমান। স্টেশন থেকে পাকিস্তান সৈন্যরা বিহারী রাজাকারদের সহযোগিতায় ১৮ সুন্দরী তরুণী ও মহিলাকে বাছাই করে আলাদা করে ফেলে।উদ্দেশ্য ক্যাম্পে নিয়ে ধর্ষণ করা। ট্রেনের বেঁচে যাওয়া এক যাত্রী তপন কুমার দাস কাল্টু জানান, ১৩ জুন ১৯৭১ সকাল ১০টার দিকে ট্রেনটি ছাড়ার পর ধপাধপ ট্রেনের সব জানালা-দরজা বন্ধ করা হচ্ছিল। তপন কুমার প্রথমে ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পাকিস্তানী সেনারা তাকে ধরে ফেলে। তখন তপন সৈন্যদের ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়।
তপন কুমার দাস সেই দিনের স্মৃতিচারণে বলেন, “পাক সেনারা ১৩ জুন আনুমানিক সকাল ৫টায় ভারতে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে ৪ টি বগিতে আমাদের তোলে। ট্রেনে ওঠার পর পাকিস্তানি সেনাদের বোঝাতে অসুবিধা হলো না, এই দিন আমাদের শেষ দিন। সে সময় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। হঠাৎ করে ট্রেন এসে ফাঁকা স্থানে দাঁড়ায়। এরপর পাকিস্তানী সৈন্যরা ট্রেনের যাত্রীদের ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে হত্যা করতে শুরু করে। যাত্রীদের অনেকে ধারাল অস্ত্রের আঘাত সইতে না পেরে গুলি করে মারার জন্য অনুরোধ করে। পাকিস্তানী সেনাদের জবাব ছিল, “মালাউন কা বাচ্চা, তুম লোগকো মারণে কি লিয়ে সারকার কা কিমতি গোলি কিউ খারচ কারু?”
তপন বাবু আরও বলেন, “একে একে বগি থেকে নামিয়ে তলোয়ার দিয়ে কাটতে শুরু করে। ট্রেনের একপাশে যখন গণহত্যা চলছিল সে সময় অন্য পাশ থেকে আমি সহ কয়েক যুবক দশ-পনেরো ফুট নিচে লাফ দিয়ে পড়ি। তখন অনেক বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা বৃষ্টির মধ্যে দৌড় দিয়ে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করি। পাকিস্তানী সেনারা পেছন থেকে আমাদের গুলি করতে থাকে। আমরা কয়েকজন পালিয়ে নিজেদের রক্ষা করলেও ওই ট্রেনের প্রায় ৪১৩ জন যাত্রী শহীদ হন। ট্রেনের দ্বিতীয় বগি থেকে পঞ্চাশ জনের মতো জীবনবাজি রেখে ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে। পাকিস্তানী সেনারা তাদের লাফিয়ে পড়তে দেখে পেছন থেকে ব্রাশফায়ার করতে থাকে। ব্রাশ ফায়ারের হাত থেকে তেইশজনের মতো বেঁচে যান। বাকি সবাইকে পাকিস্তানী সেনারা ট্রেন থেকে নামিয়ে বিহারীদের সহযোগিতায় ধারাল অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে।
পাকিস্তানী সেনারা শিশুদের আকাশে ছুড়ে তরবারির সঙ্গে বেঁধে দিয়ে দ্বিখন্ডিত করে হত্যা করে। অনেক শিশুকে পাকিস্তানী সেনারা এক পা দিয়ে অন্য পা টেনে ছিঁড়ে ফেলে হত্যা করেছে। ওই দিনের গণহত্যায় নারী ও শিশুরা বেশি শহীদ হয়েছিল। আরেক বেঁচে যাওয়া যাত্রী বিনোদ আগরওয়ালা জানান সৈয়দপুর শহর থেকে প্রায় ২ কি.মি. দূরে গোলাহাটের নিকট আসতেই ট্রেনটি থেমে যায়। এরপর কম্পার্টমেন্টের দরজা খুলে হাতে রামদাসহ ঢুকল কয়েকজন বিহারি। তিনি কম্পার্টমেন্টের বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলেন পাকিস্তানি সেনারা গোটা এলাকা ঘিরে রেখেছে। আর রামদা দিয়ে এক এক করে যাত্রীদের কোপাতে কোপাতে ট্রেন থেকে বের করে। এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ অবাঙালির কাছে পরিচিত ‘অপারেশন খরচা খাতা’ নামে, আর বাঙালিদের নিকট ‘গোলাহাট গণহত্যা’ নামে।
এই নিষ্ঠুরতা থেকে সেদিন কোনোক্রমে প্রাণে বেঁচে যান শ্যামলাল আগরওয়াল, বিনোদ আগরওয়াল, তপন কুমার দাস কাল্টু, শ্যাম সুন্দর দাস প্রমুখ। সব শেষ প্রশ্ন একটাই আজ থেকে মাত্র ৫০ বছর পূর্বে সৈয়দপুরের যে বিহারি রাজাকার আলবদর আল-শামসরা এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত তাদের বিচার করা হয়েছিল কি?
Discussion about this post