মা মনসা হিন্দুদের পূজিতা সর্পদেবী। আষাঢ় মাসের পূর্ণিমার পর পঞ্চমী তিথিতে পূজা হয় মা মনসার। মা মনসার পুজোকে কেন্দ্র করে সংগঠিত মেলা গুলির মধ্যে অন্যতম অযোধ্যা গ্রামের দশহরা উৎসব। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের নিকট দ্বারকেশ্বর নদীর তীরে অবস্থিত অযোধ্যা গ্রাম। জৈষ্ঠ বা আষাঢ় মাসের শুক্ল দশমী তিথিতে পালন করা হয় দশহরা উৎসব। দশহরার ১৫ – ২০ দিন আগে মঙ্গলবার বা শনিবারে পালিত হয় এক অভিনব রীতি গিন্নিপালন।
গিন্নিপালন উৎসবটি মূলত মহিলা কেন্দ্রিক। এই প্রথায় পুরুষ ও কুমারী মহিলাদের প্রবেশাধিকার থাকে না। লোকমুখে প্রচলিত, মা মনসা একবার ছদ্মবেশে গ্রামের মেয়েদের সাথে খেলতে আসেন। তিনি সেবাইত ও গ্রামের গিন্নিদের স্বপ্নাদেশ দেন দ্বারকেশ্বরের দক্ষিণ তীরের চটাই অঞ্চলে তার সাথে খেলতে আসতে। সেই থেকেই শুরু এই রীতির প্রচলন। গিন্নিপালনে রাজার গিন্নি হন স্থানীয় জমিদার বন্দোপাধ্যায় বাড়ির প্রতিনিধি। তার হাত ধরেই পুরো অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হয়। গিন্নি পালনের ৩-৪ দিন আগে ‘ডাকিয়া গিন্নি’, বাড়ি বাড়ি গিয়ে গিন্নিপালনে যাবার জন্য গ্রামের গিন্নিদের নিমন্ত্রণ করে আসেন।
গিন্নিপালনের আগের দিন নিমন্ত্রিত সব গিন্নিরা নিরামিষ খাবার খান। গিন্নিপালনের দিনে খুব সকালে স্নান করে নতুন বস্ত্র পড়ে নিকটবর্তী ভৈরব, কুতরাতে গিন্নিরা জড়ো হন। তাদের সাথে থাকে কাঁসার বাটি, আলতা, সিন্দুর, তেল, হলুদ, পদ্মফুল, নতুন গামছা, ফল, মিষ্টি, চিড়া ইত্যাদি। ঢাকের পেছনে দল বেঁধে মনসা মন্দিরে পৌছে গিন্নিরা একে একে পুজো দেন। বিশ্বাস করা হয়, সেবাইতদের দেওয়া মাথার ফুল মেঝেতে ফেলেই মা যাত্রার অনুমতি দেন। এরপর মায়ের অনুমতির ফুল, পান নিয়ে গিন্নিরা জৈষ্ঠের তপ্ত দুপুরে খালি পায়ে মন্দির থেকে চটাই এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সাথে চলেন ঢাকি ও কয়েকজন সহযোগী।
চটাই পৌছে তারা দুটি চূয়া কাটেন। একটি মা মনসা ও অন্যটি নিজেদের স্নানের জন্য। এরপর তারা চূয়ার থেকে ঘট করে জল তুলে তাতে সিন্দুর লাগিয়ে মনসা হিসেবে পুজো করেন। মায়ের উদ্দেশ্যে মিষ্টান্ন, ঘট, পদ্মফুল প্রদান করে নিজের মনের কথা জানান। তবে এখান থেকে কেউ কোন প্রসাদ বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন না। পুজো শেষে প্রথা অনুযায়ী রাজার গিন্নিকে রাম ও কর্মকার পাড়ার সীতাকে জাম গাছকে সাক্ষী রেখে বিবাহ দেওয়া হয়। চলে বিয়ের অন্যান্য আনুষঙ্গিক রীতি যথা মালাবদল, গিঁটালি বাঁধা ইত্যাদি। বিবাহ শেষে গিন্নিরা মেতে ওঠেন ভক্তিগীতি ও শ্যামা গীতিতে। বেলাশেষে গিন্নিরা পুনরায় মনসা পূজা করে, স্নান সেরে বাটিতে চটাইয়ের জল নিয়ে ঘাটের দিকে রওনা দেন। সেখানে বট গাছকে নয় পাক প্রদক্ষিণ করে বটগাছকে গিন্নি পালনের সাক্ষী করা হয়।
সবশেষে মনসা মন্দিরে এসে রাম সীতার গিটুলি খুলে শেষ হয় বিবাহ পর্ব। গিন্নিরা মন্দির থেকে থানে জল দিয়ে বাড়ি ফেরেন। তখন বাড়ীতে তুলসী মন্দির ও ঘরে প্রদীপ জ্বেলে অপেক্ষা করেন গিন্নির কনিষ্ঠ মেয়ে। পা ধু়ইয়ে বাড়িতে প্রবেশ করানো হয় গিন্নিকে। এরপর স্নান সেরে বাড়ির গিন্নি হন তারা। রাত্রিবেলায় মন্দিরে চলে মনসা মঙ্গলের গান। সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন প্রাচীন প্রথা আজ বিলুপ্তির পথে। তবে অযোধ্যায় আজও মহাসমারোহে পালিত হয় ব্যাতিক্রমী গিন্নিপালন।
চিত্র ঋণ – কৌলাল
Discussion about this post