২৫শে ডিসেম্বর আর বেশি দেরি নেই। বাংলার চার্চগুলো সেজে উঠছে উৎসবের সাজে। কিছুদিন পরেই চারিদিকে থাকবে আলোর রোশনাই। খ্রীষ্টমাস ট্রীতে ঝুলবে টুনি বাল্ব, রং বেরঙের কৃত্রিম ফুল। বাংলায় বেশ কিছু এমন কিছু চার্চ রয়েছে যেগুলো একই সঙ্গে ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যবাহীও বটে! সেখানেও গোটা ডিসেম্বর মাস ধরে চলে উৎসবের আমেজ। তেমনই একটি চার্চ দাঁড়িয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের গেঁওখালিতে। গেঁওখালি থেকে কয়েক মাইল মাত্র। তারপরই আসে মীরপুরের পর্তুগীজ পাড়া। কিন্তু সম্পূর্ণ গ্রামবাংলার মধ্যে হুট করে পর্তুগীজ পাড়া এলো কীভাবে? এটাই ভাবছেন তো? চলুন তবে রহস্যের জটটা সরানো যাক।
“খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে।” মায়েদের সেই ঘুমপাড়ানি সুরেই লেগে রয়েছে, বর্গীদের বাংলায় আসার গল্পটা। তখন ১৭৪২ সাল। বাংলার নবাব তখন আলিবর্দী খাঁ। নদীপথ বেয়ে বর্গীরা তখন কাতারে কাতারে বাংলায় ঢুকে পড়ছে। মহারাষ্ট্র থেকে এসে বাংলার সমৃদ্ধশালী অঞ্চলগুলোতে চলছে বর্গী হামলা, চলছে লুটপাট। বর্তমান পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলে, তৎকালীন ব্যবসা-বাণিজ্য ও বন্দরের রমরমা বাজার। রেহাই পায়নি তাই মহিষাদলও। আর জলপথে মহিষাদলে প্রবেশের রাস্তাই হল, গেঁওখালির কাছের রূপনারায়ণ নদী। মহিষাদলের রাজা আনন্দমোহন উপাধ্যায় তৎপর হয়ে উঠলেন। গোয়া সরকারের সঙ্গে করলেন যোগাযোগ। ১২ জন বন্দি পর্তুগীজ জলদস্যুকে নিয়ে আসেন বাংলায় বর্গী হামলা থেকে বাঁচতে। আর তাদের বিনাশুল্কে মোতায়েন করলেন নদীর পাশেই এই মীরপুর অঞ্চলটিতে। সমস্ত সুযোগ সুবিধা তারা পেত রাজার থেকে। এসবের বদলে রাজা বর্গী বাহিনীর থেকে রক্ষা পেলেন। তখন থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে পর্তুগীজ পাড়া। আজও এই অঞ্চলে পর্তুগীজ সেই জলদস্যুদের ১২টি উপজাতির বংশধরদের বাস। তাঁরা রক্তে পর্তুগীজ কিন্তু হৃদয়ে বাঙালি। বাংলার সংস্কৃতিকে আপন করে তারা নির্দ্বিধায় রয়ে গেছেন এখানে।
বাংলাকে আপন করলেও, তারা কিন্তু অস্বীকার করতে পারেনি তাদের পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতিকে। তাই আজও তাঁরা ডিসেম্বরের গোটা মাস জুড়ে মেতে ওঠেন প্রভু যীশুর উপাসনালয়ে। দুটি ঐতিহাসিক গীর্জা রয়েছে এখানে। একটি ক্যথলিক, অপরটি প্রোটেস্ট্যান্ট। ২৪ ডিসেম্বর রাত ১২টায় উপাসনালয়ে একত্রিত হন সবাই, চলে বাইবেল পাঠ। যাকে ‘খ্রীষ্টের জাগরণ’ বলা হয়। পরদিন ভোরে ক্যাসিও এবং ড্রাম সহযোগে শুরু হয় ‘মিশা গান’। তবে এদের বাদ্যযন্ত্রে বাংলার সংস্কৃতির ছাপ পড়ে গিয়েছে। তাই খোল কর্তালও বাজানো হয়, বের হয় নগরকীর্তন, চলে কেক বিতরণ। এভাবেই হিন্দু-মুসলিম-খ্রীষ্টান সর্ব ধর্মের মেলবন্ধন ঘটে মীরপুরের এই চার্চে।
চিত্র ঋণ – অসীম সাহা
Discussion about this post